রক্তস্বল্পতার কারণেও হতে পারে পায়ে ব্যথা
পায়ে ব্যথা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকলেও রক্তস্বল্পতাজনিত কারণেও পায়ে ব্যথা হয়। রক্তনালিতে ব্লক হয়ে এই ব্যথা করে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। কখনো কখনো পা কেটে ফেলার মতো অবস্থা তৈরি হয়।
আজ ১০ ফেব্রুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৯৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. এস এম জি সাকলাইন। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় ভাসকুলার বিশেষজ্ঞ সার্জন হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : রক্তস্বল্পতাজনিত পায়ে ব্যথা বিষয়টি কী?
উত্তর : দেখুন বিষয়টির মধ্যেই কিন্তু একটি উত্তর রয়ে গেছে। পায়ে ব্যথা অনেক কারণে হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি হলো রক্তস্বল্পতাজনিত কারণ।
এ ছাড়া নিউরোলজিক্যাল কারণ থাকে। মাংসপেশির কারণে, হাড়ের কারণে, গাঁটের কারণে পায়ে ব্যথা হতে পারে। যেহেতু আমি ভাসকুলার সার্জন, আমার আগ্রহ রক্তনালির দিকে।
রক্তস্বল্পতাজনিত কারণে পায়ে ব্যথা হতে পারে। কখনো এটি তীব্র হতে পারে। আবার হয়তো দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা হচ্ছে, রোগী হয়তো ব্যথার ওষুধ খাচ্ছে। একটি সময় হয়তো দেখা গেল তার পায়ের রক্তনালিতে ব্লক রয়েছে এবং সেটি সে হয়তো জানতও না। কখনো কখনো এর চিকিৎসা করা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করারও সুযোগ থাকে না। তার পা কেটে ফেলার মতো পরিস্থিতি হতে পারে।
প্রশ্ন : এই জাতীয় পায়ে ব্যথার কি আরো কোনো কারণ রয়েছে?
উত্তর : দেখুন হার্টে যে রকম ব্লক হয়, আমাদের রক্তনালিগুলো একই কারণে ব্লক হতে পারে। হার্টের রক্তনালিতে ব্লক হয়ে যেমন হার্ট অ্যাটাক হয়, একই কারণে পায়ের রক্তনালিতে ব্লক হয়ে পায়ে অ্যাটাক হতে পারে। সেটি যদি হাতে হয়, আমরা একে হাতের অ্যাটাকও বলতে পারি।
এই রক্তনালি বন্ধের অনেক কারণ থাকতে পারে। যারা চর্বি-জাতীয় খাবার বেশি খাচ্ছে বা যাদের রক্তে চর্বির পরিমাণ বেশি, তাদের সেখানে চর্বি জমে জমে অনেকটা চরের মতো পড়ে রক্তনালিটা আস্তে আস্তে ব্লক হয়ে যায়।
এ ছাড়া অনেকগুলো কারণ থাকে। কারো হয়তো হার্টে সমস্যা রয়েছে বা হার্টে একটি কৃত্রিম ভাল্ভ লাগানো হয়েছে। তিনি হয়তো ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন না, সেখান থেকে কোনো একটি জমাট রক্ত ছুটে গিয়ে কিন্তু পায়ে ব্লক করে দিতে পারে। এ ছাড়া যদি পায়ের রক্তনালিতে কখনো আঘাত লাগে, পায়ের রক্তনালিতে সংক্রমণ হতে পারে। যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। তবে সাধারণত দেখা গেছে যারা ধূমপায়ী তাদের রক্তনালিতে ব্লক হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
প্রশ্ন : লক্ষণ কীভাবে প্রকাশ পায় এ ক্ষেত্রে?
উত্তর : একে দুই ভাবে আমরা চিন্তা করি। একটি হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে তার হয়তো পায়ে ব্যথা হচ্ছে। একে আমরা অ্যাটাক বলছি না। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে হয়তো হাঁটতে যাচ্ছে, কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা গেল তার পায়ের যে মাংসপেশিটি সেখানে ব্যথা হচ্ছে। রোগীর ভাষা এমন থাকে যে, ‘আমার পায়ে খিল ধরার মতো ব্যথা হয়।’ দেখা যায়, সে বসে যখন বিশ্রাম নেয় তার ব্যথা চলে যায়। একটি পর্যায়ে অল্প হাঁটাতে ব্যথা হয়। এবং যখন তীব্রতা বাড়তে থাকে বা চিকিৎসা যদি এই ক্ষেত্রে না নেয়, বসে থাকার সময়ও তার ব্যথা হতে পারে। একটি পর্যায়ে বুড়ো আঙুলগুলোতে বা পায়ের পাতায় ঘা পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া দেখা যায় পায়ের লোমগুলো হয়তো পড়ে গেছে। পায়ে একটু কালচে ভাব চলে আসতে পারে।
প্রশ্ন : পায়ে ব্যথা শুরু হলেই কি রোগীর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত? বা একজন ভাসকুলার সার্জনের কাছে যে রোগীর যেতে হবে এটি রোগী কীভাবে বুঝবে?
উত্তর : হ্যাঁ, পায়ে ব্যথা হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। হঠাৎ করে যদি কারো পা ব্যথা হয়, সে কিন্তু প্রথমে ব্যথানাশক ওষুধ খায়। এমনকি দেখা গেছে সে এক্সরেও করছে, এমআরআই করছে। তার পা যখন কালো হয়ে যায় ঠিক তখন আমাদের কাছে আসে। তখন কিন্তু তেমন কিছু করার থাকে না। তবে তারা যদি প্রাথমিক পর্যায়ে আসে, যেমন কিছুদূর হাঁটতে গিয়ে ব্যথা হচ্ছে, বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাচ্ছে- ওই অবস্থায় তাকে বুঝতে হবে আমার রক্তনালিতে ব্লক থাকতে পারে। একজন চিকিৎসকের কাছে গেলে সে যদি রক্তনালিতে হাত দিয়ে দেখে পালস ঠিকমতো হচ্ছে না, তখনই সে সমস্যাটি বুঝতে পারে।
ব্যথা আসলে কী? ব্যথা হলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কান্না। আমার অঙ্গটা ঠিকমতো রক্ত পাচ্ছে না। এই না পাওয়াকে সে ব্যথা হিসেবে প্রকাশ করছে। এই সময় যদি একজন ভাসকুলার সার্জনের কাছে সে আসে, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে অনেক সময় আমরা আসল কারণটি জানতে পারি। সেভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : পরীক্ষা করার জন্য কোন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেন?
উত্তর : আমরা যদি পালস দেখি, পরীক্ষা করে বুঝে ফেলি তার গতিটি কেমন, তখনই কিছু বিষয় আমরা বুঝে নেই। এরপর কিছু সাহায্য নিতে হয়। যেমন, আমরা কম্পিউটারে ডপলার পরীক্ষা করি। এটি হলো পায়ের রক্তনালির আল্ট্রাসনোগ্রাম। এ ছাড়া একদম নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেমন : এনজিওগ্রাম।
প্রশ্ন : নিশ্চিত হওয়ার পর আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : এনজিওগ্রামের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এটি নির্ভর করে। যে কারণগুলো থাকে সেগুলো বন্ধ করতে বলি। যেমন সে যদি ধূমপান করে থাকে, তাকে এটি ত্যাগ করতে বলি। তাকে বলি চর্বিজাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকবেন। রক্তনালি চিকন হয়ে থাকলে সেটি প্রসারিত করার ওষুধ দিই। কিন্তু যদি ব্লক আছে এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চিত হওয়া যায় এবং এটি যদি ওষুধে ঠিক না হয়, সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসার অনেকগুলো পদ্ধতি আছে।
যদি ব্লকটি সামান্য অংশে থাকে, তখন একটি রিং বসিয়ে দিলে রক্তনালি সুন্দর মতো চলতে পারে।
স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক, পায়ে অ্যাটাক এগুলো আসলে আলাদা কিছু নয়। যদি মস্তিষ্কের রক্তনালি ব্লক হয় সেখানে স্ট্রোক হবে, হার্টের মধ্যে হলে হার্ট অ্যাটাক হবে। পায়ে হলে পায়ে অ্যাটাক হবে। বিষয়গুলো আসলে একই। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা কাছাকাছি। অনেকে অবাক হয়ে যায় রিং তো হার্টে পড়ানো হয়, পায়ে কীভাবে সম্ভব? আসলে পায়েও রিং পড়ানো যায়। এগুলো বাংলাদেশে সচরাচর পাওয়া যায়। হার্টে বসানো রিং যে রকম দামি তার চেয়ে পায়ের রিং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকটা কম দামি।
রিং বসালে কাটাছেঁড়ার বিষয়টি নেই। পরে যদি সে নিয়মকানুন মেনে চলে ধরে নেওয়া যায় সে ভালো থাকবে।
যদি রিং পরানোতে তার সামর্থ্য না থাকে, তখন কিন্তু আমরা অস্ত্রোপচার করে দিই। হার্টে যেমন বাইপাস করা হয়, পায়েও তার বাইবাস করে দিই। বাইপাসের ক্ষেত্রে আপনি কৃত্রিম রক্তনালি ব্যবহার করে বাইপাস করতে পারেন। অথবা তার নিজের যে রক্তনালি রয়েছে, সেটি ব্যবহার করেও বাইপাস করতে পারি। বিষয়টি নতুন হলেও রোগটি কিন্তু পুরোনো। আপনি গ্রামে গেলে দেখবেন অনেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সে জানেও না তার আসলে কী হয়েছে। একটা সময় এ রকম রোগ হলে কিন্তু পা কেটে ফেলা হতো। তবে এখন এটির আর দরকার হচ্ছে না। আগে যেমন পা বা হাত কাটতে হতো এই পর্যায়কে অনেকটাই কমিয়ে এনেছি।
এমনকি যাদের বাইপাস করতে সমস্যা হয় বা রিং বসাতে সমস্যা হয়, তাদের ক্ষেত্রেও অনেক ভালো ভালো চিকিৎসা রয়েছে। এই চিকিৎসাগুলো বাংলাদেশেই হচ্ছে। এগুলো করলে তার পায়ের রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়।
এমনকি যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রেও আমরা এসব চিকিৎসা দিয়ে পায়ের রক্তনালির প্রবাহ ঠিক করতে পারি।
প্রশ্ন : কোথায় গেলে রোগীরা এই সুবিধাটুকু পাবে?
উত্তর : এক কথায় যদি বলি, তাহলে ভাসকুলার সার্জনের কাছে গেলে এই চিকিৎসা পাবে। ভাসকুলার সার্জনরা রক্তনালির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
আমাদের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র একটি ভাসকুলার বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে ভাসকুলারের আলাদা একটি বিভাগ রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশে সরকারিভাবে মাত্র এই দুটি জায়গায় চিকিৎসা পাওয়া যায়। অথচ রোগী কিন্তু অনেক বেশি।