রগ কেটে গেলে করণীয়
রগ কাটা আমাদের দেশে একটি বহুল আলোচিত শব্দ। পত্রপত্রিকা, লোকমুখে প্রায়ই শোনা যায় রগ কাটা হয়েছে। সন্ত্রাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রগ কাটা জাতীয় সমস্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত এ রকম অনেকের কাছেই রগ কাটা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা রয়েছ। তাদের ধারণা, কাটা রগ ভালো করা যায় না। তবে সময়মতো এবং দ্রুত এর চিকিৎসা দেওয়া গেলে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যেতে পারেন। এই রগকেই বলে টেনডন।
টেনডন কী
রগ বা টেনডন সম্পর্কে জনগণের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে শরীরের রক্ত বহনকারী নালিকে রগ মনে করে থাকেন। তবে প্রকৃতপক্ষে রগ এবং রক্তনালি একই জিনিস নয়। রগ বা টেনডন হচ্ছে আমাদের শরীরের মাংসপেশির উৎপত্তিস্থল ও পরিসমাপ্তিস্থলের অংশবিশেষ। এর সাহায্যে মাংসপেশি শরীরের বিভিন্ন হাড় জোড়া বা জয়েন্ট তৈরি করে। মাংসপেশির সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে ওই মাংসপেশির উভয় প্রান্তের রগের মাধ্যমে হাড় জোড়া বা জয়েন্টের নড়াচড়া হয় এবং এর কারণে হাঁটাচলা থেকে শুরু করে হাত-পা দিয়ে যাবতীয় কাজকর্ম করা হয়।
কোনো কারণে যদি মাংসপেশির সঙ্গে সংযুক্ত রগ কেটে যায়, তবে আমরা ওই রগ দিয়ে সম্পাদিত অস্থিসন্ধির নড়াচড়া চালাতে সম্পূর্ণ বা আংশিক ব্যর্থ হই। সুতরাং অস্থিসন্ধির সম্পূর্ণ নড়াচড়ার জন্য সুস্থ রগ এবং সুস্থ সচল স্নায়ু অপরিহার্য।
রগ কেটে গেলে করণীয়
রগ বা টেনডন কেটে গেলে, ক্ষতস্থানে কোনো ময়লা লেগে থাকলে তা পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন এবং পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থান ভালো করে চেপে ধরে একজন শল্যচিকিৎসক বা অর্থোপডিক সার্জনের কাছে যান।
ছয় ঘণ্টার মধ্যে কাটা রগের চিকিৎসা
দুর্ঘটনা ঘটার ছয় ঘণ্টার মধ্যে ক্ষতস্থান ভালোভাবে পরিষ্কার করে সেলাই করতে পারলে কাটা রগ এবং অস্থিসন্ধির কার্যক্ষমতা শতভাগ পাওয়া সম্ভব। এটিই কাটা রগের সর্বোত্তম চিকিৎসা। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যত্রতত্র পরিষ্কার না করে অপারেশন থিয়েটারে জীবাণুমুক্তভাবে করা উচিত। রক্তনালি ঠিক আছে কি না, তাও ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা
ছয় ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইনফেকশনের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। এতে চিকিৎসার সুফল কমে আসতে থাকে। তথাপি দুর্ঘটনা ঘটার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা করা সম্ভব হলে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ রেখে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
চব্বিশ ঘণ্টা পর কাটা রগের চিকিৎসা
রগ কাটা যাওয়ার পর সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাংসপেশির সংকোচনের মাধ্যমে রগ ছোট হয়ে যেতে পারে এবং কাটা রগের চিকিৎসা জটিল হয়ে যায়। তখন অনেক সময় রগ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অস্ত্রোপচার যেমন জটিল ও কষ্টসাধ্য, তেমনি এর ফলও অনেক ক্ষেত্রে সন্তোষজনক হয় না।
শরীরের কোথায় কোথায় সহজে রগ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে
১. পায়ের গোড়ালির পেছনে টেনডো একিলিস নামে যে শক্ত রগ থাকে, তা সহজেই আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। যেমন : হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে গর্তে বা রাস্তার ঢাকনাবিহীন স্যুয়ারেজ লাইনে, কমোডে বা শত্রুতাবশত কেউ এই শক্ত রগ কেটে দিলে। এতে পা নড়াচড়া করা কষ্টকর হবে এবং হাঁটতেও খুব অসুবিধা হয়।
২. হাতের কব্জির সম্মুখভাগ ও পেছনের ভাগের পাঁচটি করে দশটি রগ কেটে যেতে পারে বা আলাদা আলাদাভাবে যেকোনো একটি বা একাধিক রগ কেটে যেতে পারে।
যেভাবে রগ সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
১. উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা শত্রুতাবশত রগ কেটে দিলে।
২. দুর্ঘটনাবশত, যেমন—ধারালো কাঁচি, জানালার গ্লাস, ধারালো ছুরি, বুলেট ইত্যাদি দিয়ে কব্জির ওপর বা নিচে। সামনে বা পেছনে অথবা পায়ের গোড়ালির পেছনের রগ কেটে যেতে পারে।
৩. পায়ের গোড়ালির পেছনের দিকের রগ কেটে যাওয়ার আরো একটি নিত্যকার দুর্ঘটনা হচ্ছে পায়ের চাপে পায়খানার পা-দানি ভেঙে গেলে পা তোলার মুহূর্তে পেছনের অংশ কেটে যেতে পারে।
একটি কথা মনে রাখবেন, সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া গেলে কাটা রগ ভালো করা সম্ভব। রগ কাটা রোগীর অযথা সময় নষ্ট না করে দ্রুত নিকটবর্তী শল্যচিকিৎসকের বা অর্থোপডিক সার্জনের কাছে গিয়ে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক : স্বাস্থ্য নিবন্ধকার, কথাসাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।