শুচিবায়ুগ্রস্ততা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/03/27/photo-1427458344.jpg)
মেহজাবিন চৌধুরী (ছদ্মনাম) একজন গৃহিণী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে থাকেন যেন কোনো জিনিসে জীবাণু না থাকে।
প্রতিদিন অনেকবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে থাকেন। এমন অবস্থা হয়েছে যে হাতে ঘা হয়ে গেছে। তিনি জানান, এ নিয়ে পরিবারের লোকজন খুব বিরক্ত। কিন্তু তিনি নিজেকে থামাতে পারেন না।
৪৮ বছর বয়সী হাবিবুর রহমানের (ছদ্মনাম) সারা দিন চলে যায় নানা কিছু চেক করতে করতে। জানালা ঠিকমতো লাগানো হলো কিনা; গ্যাসের চুলা, ইলেকট্রিক সুইচ বা পানির কল বন্ধ হয়েছে কিনা; তালা সঠিকভাবে লাগানো হয়েছে কিনা- এসব চেক করতে থাকেন বারবার।
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, রুমাল পকেটে নিয়েছি কি না এটা বারবার চেক করতে করতে অফিসে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এগুলো দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটায়। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।’
মেহজাবিন চৌধুরী বা হাবিবুর রহমান যে সমস্যায় ভুগছেন, তা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। একে বলে শুচিবায়ুগ্রস্ততা। সাধারণত এই সমস্যাটিকে খুঁতখুঁতে স্বভাব বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই স্বভাবের তীব্র মাত্রাকে মানসিক রোগ হিসেবে দেখা হয়। এটি বাতিক, বাধ্যতামূলক বৈকল্য বা ওসিডি নামে পরিচিত।
ওসিডির লক্ষণ
ওসিডির লক্ষণ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সালমা পারভীন বলেন, ‘অনেক সময় ব্যক্তি কিছু ভাবনা-চিন্তা বা দৃশ্য কল্পনায় দেখেন এবং কোনো কিছু করে ফেলার তাড়না অনুভব করেন যা তাঁর জন্য প্রচণ্ড অশান্তিকর ও অস্বস্তিদায়ক। ব্যক্তি নিজেও জানেন না তাঁর এসব চিন্তা অযৌক্তিক কিন্তু সে নিজে এটা মাথা থেকে সরাতে পারেন না। এসব চিন্তা থেকে ব্যক্তির মধ্যে তীব্র উত্তেজনা, উদ্বিগ্নতা, ভয়, অশান্তি, অপরাধবোধ, পাপবোধ, ঘৃণাবোধ ইত্যাদি কাজ করতে পারে। এই তীব্র অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে ব্যক্তি নিজেকে অন্য কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত করে। যেমন : বারবার হাত ধোয়া, কোনো কিছু বারবার চেক করা যা অল্প সময়ের জন্য ভালো অনুভূতি তৈরি করে।’
অনেকের মধ্যে অপ্রীতিকর বা অস্বস্তিকর কোনো শব্দ বা বাক্য মনে পড়তে থাকে, যা অন্য কেউ শুনলে আঘাত পাবে। আবার বাক্যগুলো এমন হতে পারে যা খুব কাছের আত্মীয়স্বজন, এমনকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কটূক্তিপূর্ণ।
কখনো কখনো নোংরা হয়ে যাওয়া বা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিজের অসতর্কতার ফলে অন্যের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
পরিবারের কেউ মারা যাচ্ছে বা ব্যক্তি কাউকে মেরে ফেলছে, এমন ভাবনাও আসতে থাকে। আবার অনেকে নিজেকে কুরুচিপূর্ণ যৌনকাজে অংশগ্রহণ করতে দেখে, যা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে না।
সব সময় সন্দেহ কাজ করে হয়তো জানালা-দরজা ঠিকভাবে লাগানো হয়নি। আবার বাইরে গেলে হয়তো খারাপ কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় কাজ করতে থাকে।
কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে ওই চিন্তার অনেক গভীরে চলে যাওয়া এবং অনেক বিষয়ে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটতে পারে।
কারণ
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সালমা পারভীন জানান, ‘এ সমস্যা জিনগত কারণে হতে পারে। জীবনের বিভিন্ন চাপমূলক পরিস্থিতিও ওসিডির জন্য দায়ী। যেমন- জীবনের পরিবর্তন, বয়ঃসন্ধি, শিশুর জন্ম, নতুন চাকরি এসব বিষয় ওসিডির লক্ষণ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পরিপাটি থাকা, রীতিনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে যত্ন, উচ্চ আদর্শ এসব যখন মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায়, তখন ওসিডি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মস্তিষ্কের নিউরো ট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে এটি হয়।’
সমস্যা
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অভ্রদাস ভৌমিক জানান, এই সমস্যায় মানুষ ধীরগতির হয়ে যায়। অনেক সময় সে হয়তো বোঝে এটি তার সমস্যা। কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসা
অভ্রদাস ভৌমিক জানান, সাধারণত দুভাবে এর চিকিৎসা করা হয়। ওষুধের মাধ্যমে এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে। ওষুধের ক্ষেত্রে এসএস আরআই, টিসিএ-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এগুলো অবসেশন রোধে কাজ করে।
সাইকোথেরাপির ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপিস্টরা মূলত দুই ভাগে থেরাপি দিয়ে থাকেন জানিয়ে সালমা পারভীন বলেন, এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ (এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনশন) এবং ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা (কগনেটিভ থেরাপি) নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি শেখানো হয়।
সালমা পারভীন বলেন, এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনশন এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কোনো চাপমূলক পরিস্থিতিতে যদি আমরা অনেকক্ষণ থাকি তাহলে আমাদের উদ্বেগ ও অস্থিরতা বেড়ে যায়। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কমে আসে। তাই যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ওসিডি আক্রান্ত রোগী ভয় পায় এবং তার অস্থিরতা ও উদ্বিগ্ন ভাব কমানোর জন্য যা করে থাকে (বারবার হাত ধোয়া, বারবার চেক করা) তা থেকে বিরত থাকতে বলা হয় এবং ততক্ষণ পর্যন্ত বিরত থাকতে বলা হয় যতক্ষণ না অস্থিরতা কমে আসছে। এভাবে ব্যক্তি তার বাধ্যতামূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কারো হাতে ময়লা লেগে আছে এই ভেবে সে যদি বারবার হাত ধোয়, তাহলে তাকে হাত ধোয়া থেকে বিরত রাখার অভ্যাস শেখানো হয়। এক সময় এই হাত ধোয়ার তাড়না ধীরে ধীরে কমে আসে।
আর ত্রুটিপূর্ণ চিন্তার পদ্ধতির ক্ষেত্রে চিন্তাকে সহজভাবে নিতে শেখা এবং চিন্তাগুলোর যৌক্তিকতা বুঝতে সাহায্য করা হয়।
অভ্রদাস ভৌমিক বলেন, “অনেক সময় ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ময়লার মধ্যে নিয়ে যাওয়ায় অভ্যস্ত করা হয়। যে পরিস্থিতিতে উদ্বেগ হয় সেখানে ধীরে ধীরে প্রকাশ (এক্সপোজ) করা হয়। এ ছাড়া স্টপ থটিং বা চিন্তা এলে চিন্তাটি হতে না দেওয়া শেখানো হয়। এ ক্ষেত্রে হাতে রাবার বেঁধে কিছুটা ফাঁক করে ছেড়ে দিতে হবে। চিন্তাকে বলতে হবে ‘স্টপ’ বা ‘থামো’। উত্তেজনার মুহূর্তে এটি করে অভ্যস্ত হতে হবে।”
নিজেকে কীভাবে সাহায্য করবেন
অভ্রদাস ভৌমিক বলেন, অল্প অল্প করে বিষয়গুলোর সাথে অভ্যস্ত হতে হবে। চিন্তা বারবার মাথায় এলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইতিবাচক চিন্তার মধ্য দিয়ে একে অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হবে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সালমা পারভীন বলেন, কষ্টকর চিন্তার সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করান। যদিও এটা শুনতে অদ্ভুত শোনায়, কিন্তু এর মাধ্যমে আপনি চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। চিন্তাগুলোকে মুখে বলবেন বা রেকর্ড করবেন। পরে বারবার শুনবেন। অথবা চিন্তাগুলোকে লিখে রাখতে পারেন। এটা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করতে পারেন যতক্ষণ না উত্তেজনা কমে আসে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
মনোবিশেষজ্ঞ অভ্রদাস ভৌমিক বলেন, ছোটখাটো সমস্যা সব সময় থাকতে পারে। কিন্তু চিন্তাটি যদি বারবার আসতে থাকে এবং কাজের গতি কমিয়ে দেয়, যদি সমস্যাগুলো খুব তীব্র হয় যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না অথবা সামাজিক-পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রে সমস্যার তৈরি করে; তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পরিবার ও বন্ধুরা কীভাবে সাহায্য করতে পারেন
সালমা পারভীন জানান, ওসিডি আছে এমন ব্যক্তির আচরণ অনেক সময় হতাশাজনক হতে পারে। এই বিষয়টি সবাই মনে রাখতে চেষ্টা করবেন যে বিষয়টি সে ইচ্ছা করে করছে না। তাকে ভীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে উৎসাহিত করুন। চেকিংয়ে সাহায্য চাইলে না বলুন। ব্যক্তি যদি বার বার নিশ্চয়তা চায় এ ক্ষেত্রে তাদের নিশ্চয়তা দেবেন যে সব ঠিক আছে।
ওসিডির লক্ষণ কম থাকলে ব্যক্তি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা ছাড়াই প্রাত্যহিক জীবনের সব কাজ করতে পারে। কিন্তু অবস্থা যখন খারাপের দিকে যায় এবং পারিবারিক জীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি।