নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন জরুরি
মাঝে মাঝেই আমরা শুনি, রোগী চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করায় রোগ জটিল হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় হয়তো চিকিৎসকের আর কিছুই করার থাকে না। এ ছাড়া বর্তমানে আমাদের জীবনযাপনের কারণেও অনেক ধরনের অসুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন : অতিরিক্ত ফাস্টফুড গ্রহণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম না করা, কম ঘুমানো ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা হয়। এসব অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে যদি প্রাথমিক অবস্থা থেকেই সতর্ক থাকা যায় তাহলে রোগ জটিল হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। আগে থেকে সচেতন হলে কঠিন অসুখ হওয়ার প্রবণতাও অনেকটাই কমে যায়। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা কেন জরুরি এই বিষয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিস বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার ডা. সেলিনা লাইওয়ালা বলেন, বর্তমান সময়ে আমাদের যে ধরনের জীবনযাপন করতে হয় সে কারণে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমান ব্যস্ততার যুগে ঘরের তৈরি খাবারের বদলে বাইরের খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মানুষের মধ্যে উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা- এগুলো বেড়েছে। আমরা সাধারণত কায়িক পরিশ্রম কম করি বা কম হাঁটাহাঁটি করি। যার ফলে বিভিন্ন অসুখ হচ্ছে। এ ছাড়া অসুস্থ হওয়ার কিছু বংশগত কারণও রয়েছে। যেমন : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি। আর রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা করার থেকে হওয়ার আগে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ভালো। তাই বছরে একবার হলেও চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেকআপ করা প্রয়োজন। প্রাথমিক অবস্থায় যদি রোগটি নির্ণয় করা যায় তবে অনেক সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তাই সুস্থ জীবন এবং দীর্ঘায়ুর জন্য নিয়মিত চেকআপ করতে হবে।
অ্যাপোলো হাসপাতালের একসিডেন্ট ও ইমার্জেন্সি বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ হাসান আন্দালীব বলেন, বেশির ভাগ মানুষের প্রবণতা হচ্ছে রোগ হওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। তবে আগে থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করার ঝুঁকি কমে যায়। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা আপনাকে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা থেকে সতর্ক করে দেবে। এর ফলে আগে থেকেই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই একটি মানুষের ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য নিয়মিত চেকআপ অবশ্যই জরুরি।
ডা. সেলিনা জানান, বাংলাদেশে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন বিভিন্ন হাসাপাতালে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যেসব হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিভাগ আছে সেখানে গিয়ে এই চেকআপ করতে হবে। সেখানকার চিকিৎসক এবং পুষ্টিবিদরা জানাবেন আপনার শরীরের জন্য কী খাওয়া উচিত এবং প্রাথমিকভাবে কী করা উচিত। রোগ অনুযায়ী কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে- এ বিষয়গুলোও জানিয়ে দেবেন তাঁরা।
ডা. মুহাম্মদ হাসান আন্দালীব জানান, এখন বড় হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ থাকে। এই প্যাকেজে অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। আপনি আপনার পছন্দ অনুযায়ী প্যাকেজ নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারবেন।
সাধারণত কী ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি এ বিষয়ে ডা. সেলিনা জানান, রক্তচাপ, রক্তে শর্করার পরিমাপ, কিডনির কার্যক্রম এগুলো নিয়মিত চেক আপ করতে হবে। এ ছাড়া কলেস্টেরল, রক্তে শর্করার পরিমাপ, হিমোগ্লোবিন টেস্ট, কিডনি, আই-চেকআপ করতে হবে। পাশাপাশি উচ্চতা এবং ওজন দেখে ডায়েট প্রেসক্রিপশন করাতে হবে।
যেসব পরীক্ষাগুলো নিয়মিত করা জরুরি
- সিবিসি : সিবিসি চেকআপের মাধ্যমে শরীরের হিমোগ্লোবিন, সাদা কণিকা (সেল) এবং প্লেটলেট গণনা করা হয়। শরীর থেকে রক্ত নিয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে বা মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করা হয়। শরীরে হিমোগ্লোবিনের সর্বনিম্ন মাত্রা ১৩ গ্রাম পারডিএল। হিমোগ্লোবিন যদি এর নিচে নেমে যায় তাহলে রোগী এনিমিয়ায় আক্রান্ত হয়। তবে এই সংখ্যাগুলো গবেষণাগার ভেদে ভিন্ন হতে পারে। সাদা কণিকা সচরাচর চার থেকে ১১ হাজার পারডিএল হয়ে থাকে।প্লেটলেট দেড় লাখ থেকে চার লাখ পার ডিএল হয়ে থাকে।অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাস জ্বরে প্লেটলেটের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।যেমন,ডেঙ্গু জ্বর।যদি সাধারণ মাত্রার বাইরে যায় তবে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
- এইচবিএওয়ানসি : এটি ডায়াবেটিসের একটি পরীক্ষা। গত তিন মাসে রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা কেমন ছিল সেটি এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব। সাধারণত এইচবিএওয়ানসির মাত্রা ছয় এর নিচে হলে ভালো হয়। তবে সাত পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য । সাত দশমিক আট পর্যন্ত অতিরিক্ত এবং এর উপরে হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই বলে ধরে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
- টিএসএইচ : এই পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে থাইরোয়েড গ্রন্থির পরিমাপ দেখা হয়। শরীরের হাইপারথাইরোয়েডিজম আছে কি না সেটি নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
- সিরাম লিপিড প্রোফাইল : রক্তে চর্বির পরিমাণ কেমন রয়েছে এই পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি বোঝা যাবে; এটিও একটি রক্তের পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ট্রাইগ্লিসারাইট বা টিজি, লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (এলডিএল), হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রটিন (এইচডিএল) এবং সম্পূর্ণ কোলেস্টেরলের মাত্রা দেখা হয়।একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এলডিএলের মাত্রা ১০০ গ্রাম পার ডিএল হলে ভালো হয়; যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে এইচডিএল যার মাত্রা ৪০-এর বেশি হলে ভালো হয়; যা ভালো কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত।কোলেস্টেরলের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। এ কারণে আমাদের নিয়মিত কোলেস্টেল পরীক্ষা করা উচিত এবং অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
- কিডনি ফাংশন টেস্ট : এই পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির কার্যক্ষমতা নির্ণয় করা হয়। এখানে রক্তে ইউরিয়া, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, সিরাম ইলেকট্রোলাইটস এগুলো দেখা হয়। কিডনির রোগের ক্ষেত্রে সিরাম ইউরিয়া এবং ক্রিয়েটিননের মাত্রা বেড়ে যায়। এর কারণে শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ তৈরি হয়। একজন সুস্থ মানুষের ক্ষেতে রক্তে ইউরিয়ার পরিমাণ হবে ৪০ এমএলপারডিএলের নিচে। তেমনিভাবে ক্রয়েটিনিনের মাত্রা এক দশমিক দুই মিলিগ্রাম পারডিএলের নিচে থাকা উচিত। কিছু কিছু কারণে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন, রক্তক্ষরণ, প্রভৃতি কারণে ইউরিয়া এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। কিডনির ফাংশন টেস্ট যদি অস্বাভাবিক হয় তাহলে নেফ্রোলোজিস্টের কাছে যেতে হবে।
- সিরাম ইউরিক এসিড : এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের ইউরিক এসিডের পরিমাণ দেখা হয়। ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে শরীরে বিভিন্ন অংশে তীব্র ব্যথা হতে পারে। যা আপনার কার্যক্রমকে ব্যহত করবে। ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষ এবং নারীর বেলায় ভিন্ন হয়।এই মাত্রাও পরীক্ষাগার ভেদে ভিন্ন হতে পারে। ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। নয়তো কিডনিতে সমস্যা এবং গাট বা জয়েন্টে সমস্যা হতে পারে।
- ইউরিন ফর আর/ এম/ ই : এর মাধ্যমে প্রস্রাবের রং, শর্করা, প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরনের কণিকা (সেল) ইত্যাদি দেখা হয়। সচরাচর এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রস্রাবের সংক্রমণ দেখা হয়।এ ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে এ রোগের নিয়ন্ত্রণ কেমন আছে সেটিও বোঝা যায়। সর্বোপোরি এটি কিডনির কার্যক্রম পরীক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
- লিভার ফাংশন পরীক্ষা : এই পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের কার্যক্ষমতা দেখা হয়। এর মধ্যে সিরাম বিলুরুবিন, এসজিপিটি ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। কেউ জন্ডিসে আক্রান্ত কি না এই পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি দেখা হয়।সিরাম বিলুরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ২ মিলিগ্রাম পারডিএলের নিচে থাকা উচিত। তেমনভাবে এর এসজিপিটি এবং এসজিওটির মাত্রা ৪০ এর নিচে থাকতে হবে।এই পরীক্ষার মাধ্যমে সিরাম অ্যালবুমিনও দেখা হয়; যা স্বাভাবিক তাপমাত্রার নিচে থাকলে শরীরে পানি আসতে পারে।
- এইচবিএসএজি এবং অ্যান্টিএইচবিএস : এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি শরীরে আছে কি না সেটি নির্ণয় করা হয়। যদি পরীক্ষায় এটি ধরা পড়ে তবে অবশ্যই গ্যাসট্রোএনটেরোলোজিস্টের কাছে যেতে হবে।
- ইসিজি : এর মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের অবস্থা পরীক্ষা করা হয়। মূলত এরিদমা বা ইসক্যামিক হৃদরোগ আছে কি না এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে এটি নির্ণয় করা হয়।ইসিজি বিভিন্ন রকম হয়।যেমন : রেস্টিং ইসিজি (এই বেশি পরিমাণে করা হয়),এক্সারসাইজ ইসিজি বা ইটিটি প্রভৃতি।
- আরএইচ ফেক্টর : এই পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার শরীরে রক্তের গ্রুপ কী সেটি জানা যাবে।
- এক্সরে চেস্ট : এর মাধ্যমে বুকের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ কী অবস্থায় থাকে সেটি পরীক্ষা করা হয়। মূলত শ্বাসনালির সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া শনাক্তকরণে এটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।এ ছাড়া এর মাধ্যমে হৃদযন্ত্র স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বড় কি না বা ফুসফুসে পানি জমেছে কি না প্রভৃতি শনাক্ত করা হয়।
- আল্ট্রাসোনোগ্রাম : আল্ট্রাসোনোগ্রাম করা হয় পিত্তথলি বা পিত্তনালিতে পাথর আছে কি না, সার্বিকভাবে পেটের ভেতরে অঙ্গগুলোর গঠনগত কোনো সমস্যা আছে কি না সেটি বোঝার জন্য। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় এই পরীক্ষার মাধ্যমে ভ্রূণের গঠনগত অবস্থা বোঝা যায়।তাই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত আল্ট্রাসোনোগ্রাম করা হয়ে থাকে।
যেসব জায়গায় নিয়মিত চেকআপের ব্যবস্থা রয়েছে
অ্যাপলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ল্যাব এইড ইত্যাদি জায়গায় নিয়মিত চেকআপের ব্যবস্থা রয়েছে।
তাই আগে থেকে সাবধাণতা অবলম্বন করলে এবং নিয়মিত জরুরি স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলো করালে সুস্থভাবে দীর্ঘজীবী হয়ে জীবনযাপন করা সম্ভব।