কর্নিয়া সংযোজনে অন্ধত্ব দূর
একজন মানুষের অন্ধত্ব নানা কারণে হতে পারে। তার মধ্যে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব হলে এর সংযোজন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা যায়। আজ ১১ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ হারুন আই ফাউন্ডেশন হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. সৈয়দ এ হাসান।
urgentPhoto
প্রশ্ন : একজন মানুষের কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের কারণ কী, এটি কেন ঘটে?
উত্তর : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের প্রধান কারণ অ্যাগরিকালচারাল ট্রমা। যেহেতু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিতে কাজ করে, ওখান থেকে যে আঘাত হয়, আঘাত থেকে কর্নিয়াতে সংক্রমণ হয়।
প্রশ্ন : অ্যাগরিকালচারাল ট্রমা মানে কী? কী আঘাত লাগে এখান থেকে?
উত্তর : ক্ষেতে খামারে কাজ করতে গিয়ে ধানের শিষ এসে লাগে, ধানের পাতা লাগে, ধান মারাই করার সময় ধান ছিটে আসে, এসব কাজ করার সময় আসলে বেশি আঘাতগুলো লাগে। ওই সব জায়গাতে সব সময় ফাঙ্গাশ থাকে। এ কারণেই ফাঙ্গাল ইনফেকশন বেশি হয়। এটি খুব বাজে একটি রোগ। ভালো করতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় কর্নিয়া খারাপ হয়ে যায়। ভালো চিকিৎসা করলে হয়তো কিছু কর্নিয়া বাঁচানো যায়। বাঁচানো গেলেও দেখা যায় কর্নিয়া ঘোলা হয়ে গেছে, স্বচ্ছতা থাকে না। তখন কর্নিয়া সংযোজন ছাড়া পথ থাকে না। এটি এক ধরনের কর্নিয়ার সমস্যা হওয়ার কারণ।
দ্বিতীয়ত হয় জন্মগতভাবেই। কিছু মানুষের কর্নিয়া খারাপ হতে পারে। কিছু কিছু দেখা যায় কর্নিয়ার সামনের দিকটা খারাপ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় কর্নিয়ার পেছনের দিকটা খারাপ।
তৃতীয় কারণ যদি বলি, আমাদের দেশে এখন হাজার হাজার ছানির অস্ত্রোপচার হচ্ছে। ছানি অস্ত্রোপচার করার সময় কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গিয়ে অনেক সময় কর্নিয়ার পেছনের অংশটা খারাপ হয়ে যায়। তাতে গিয়ে দেখা যায় কর্নিয়া আবার ঘোলা হয়ে যায়।
প্রশ্ন : যে কারণেই হোক যদি কর্নিয়া নষ্ট হয়ে যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্ধত্ব বরণ করে একে ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় কী?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে আসলে কর্নিয়ার সংযোজন ছাড়া পথ নেই। এটি একটি স্বচ্ছ জিনিস। আমরা যেটা দেখি চোখের সামনে কালো একটা অংশ। এটা শুধু কালো নয় এটা স্বচ্ছ। এর পেছনে যে পর্দা থাকে একে আইরিশ বলা হয়। সেটা বিভিন্ন রঙের হয়। আসলে কর্নিয়ার কোনো রং নেই। এটা স্বচ্ছ কাঁচের মতো। সেই কাঁচের স্বচ্ছতাটা যখন হারিয়ে যায় তখনই আমরা আসলে ওই কর্নিয়া দিয়ে দেখতে পাই না। দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। অথবা কখনো কখনো এমন হয় শুধু আলোই দেখতে পায়। অন্য কিছু দেখতে পায় না।
প্রশ্ন : কর্নিয়ার কারণে অন্ধত্ববরণ করলে সংযোজনই কি সমাধান, না কি অন্য কোনো কিছু দিয়ে সমাধান করা যায়?
উত্তর : কর্নিয়া যদি অস্বচ্ছ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে অন্য ব্যক্তিরটা নিয়ে সংযোজন ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই। অন্য কোনো প্রাণীর কর্নিয়া লাগালে হবে না।
প্রশ্ন : সেই ক্ষেত্রে একজন মানুষের কর্নিয়া আপনারা কীভাবে নিয়ে থাকেন?
উত্তর : মরণোত্তর চক্ষুদানই মূল বিষয়। কেউ যদি মরণের আগে দিতে চায় তাহলে আমরা উদ্বুদ্ধ করি না। আইন আছে, যদি কোনো মানুষ জীবিত অবস্থায় কর্নিয়া দান করতে চায়, সে এক চোখ দান করতে পারবে। যে নেবে তার অবশ্যই দুই চোখ যদি খারাপ হয় এক চোখ নিতে পারে। তাহলে কোনো মানুষই আসলে অন্ধ থাকল না। যে দিল সেও এক চোখ দিয়ে দেখতে পারবে, আর যে নিল তার দুই চোখ খারাপ ছিল একটা দিয়ে দেখতে পেল।
এটাও আসলে করা লাগে না। মানুষ যদি দান করে মারা যাওয়ার পরে যে পরিমাণ কর্নিয়া আমাদের জমা হবে, এতে সুস্থ মানুষেরটা নেওয়া লাগবে না। যেমন এখন তো আমাদের কর্নিয়া সংগ্রহ করে শুধুমাত্র সন্ধানী আই ব্যাংক। সন্ধানী আই ব্যাংকের প্রত্যেক মেডিকেল কলেজে শাখা আছে। কর্নিয়া দান করতে চাইলে এসব জায়গায় যোগাযোগ করতে চাইলেই দান করতে পারে।
প্রশ্ন : কারা দান করতে পারে?
উত্তর : দান করতে পারে যেকোনো মানুষ, তবে মারা যাওয়ার পরে। আগে যেমন কারো যদি চোখের ভেতরে অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে তাদের কর্নিয়া নেওয়া হতো না। কারণ আগের ছানি অস্ত্রোপচারের মান তেমন ভালো ছিল না। কারণ তখন ছানির সার্জারি করার সময় কর্নিয়ার পেছনের অংশ যে পরিমাণ খারাপ হয়ে যেত সেটা নিয়ে সংযোজন করা যেত না। এখন সেই কারণটাও চলে গেছে। যেহেতু ছানির অস্ত্রোপচারের মান অনেক ভালো, তাই ওই সব মানুষও এখন কর্নিয়া দিতে পারে। এখন যেকোনো বয়সের মানুষ কর্নিয়া দিতে পারে।
প্রশ্ন : যেকোনো বয়সে কর্নিয়া দিতে পারার প্রক্রিয়াটা কী? ধরেন আমি কর্নিয়া বা মরণোত্তর চক্ষুদান করতে চাই। এটার প্রক্রিয়াটা কী?
উত্তর : যদি মানুষ কর্নিয়া দান করতে চায় বা করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে সে সন্ধানী আই ব্যাংকে যোগাযোগ করতে পারে।
প্রশ্ন : সন্ধানী আই ব্যাংক কোথায় আছে?
উত্তর : এর প্রধান অফিস কাঁটাবনে। এবং এদের শাখা আছে সব মেডিকেল কলেজে। অথবা কোনো চিকিৎসকের কাছে যদি জানতে চায় রোগী তাহলে তথ্য তো পাবেই।
প্রশ্ন : শরীরের কোনো অংশ দানের বিষয়ে ধর্মীয় বিষয়টি সামনে আসে, যে সে ধর্মীয়ভাবে কর্নিয়া দান করতে পারবে কি না। এ বিষয়টি কী?
উত্তর : কর্নিয়া দান করা যাবে না- এ বিষয়ে ধর্মে কোথাও লেখা নাই। কিন্তু ধর্মে এটাও বলা নাই যে দান করো। আসলে যেটা হয়েছে ফিকা একাডেমি অব মক্কা থেকে বলা হয়েছে, মরণোত্তর চক্ষুদানে কোনো সমস্যা নেই। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বলা হয়েছে, এতে কোনো সমস্যা নেই। আর আমাদের ধর্মেও কোথাও বাধা নেই যে দেওয়া যাবে না। ধর্মীয়ভাবে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
প্রশ্ন : এর জন্য চোখ কি পুরো তুলে নিতে হয়?
উত্তর : আগে একসময় আইবলটা নেওয়া হতো। এখন যেটা হয় শুধু কর্নিয়া এবং কর্নিয়া সাদা অংশের একটা রিম নেওয়া হয় এবং ওখানে কৃত্রিম একটি সেল বসিয়ে দেওয়া হয়, যাতে চোখের কোনো অংশের বিকৃতি হয় না। তার মানে দেখতে বিকৃত হওয়া, খারাপ লাগা এ ধরনের কোনো সমস্যাই হচ্ছে না।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এই কর্নিয়া দান করার প্রবণতা নেই। কিন্তু অনেক রোগীই কর্নিয়ার কারণে অন্ধত্ববরণ করে এবং তাদের দরকার। এখন আপনারা কর্নিয়া পাচ্ছেন কী করে?
উত্তর : সন্ধানী হাসপাতাল তো কর্নিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু কর্নিয়া দেওয়ার পরিমাণটা এত কম যে সে এটা পেতে হয়তো এক থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। এত সময় লাগলে ওই রোগী হয়তো অন্য কোথাও সংযোজন করে ফেলে অথবা চোখটা নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে আসলে সমস্যাটা থেকেই যায়।
তবে এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু কর্নিয়া পাচ্ছি। ওরা এর জন্য কিছু পয়সাও নেয়। ওখানে যে কর্নিয়া পাচ্ছি এর কোয়ালিটিও ভালো। আমাদের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয় এখান থেকে।
প্রশ্ন : যুক্তরাষ্ট্রে কর্নিয়াদানের প্রবণতা বেশি। তাদের নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত যা থাকে, সেটা এই আই ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে পাই। এভাবে এ কারণে যারা অন্ধত্ব বরণ করছেন তারা কর্নিয়া পায়...
উত্তর : একসময় যুক্তরাষ্ট্রেও কর্নিয়ার অভাব ছিল। তারা শুধুমাত্র একটা আইন পরিবর্তন করেছে, যাদের হাসপাতালে মৃত্যু হবে, তাদের কর্নিয়া দান করতে হবে।