অতিরিক্ত ঘাম হলে কী করবেন
ঘাম শরীরের অত্যাবশ্যকীয় একটি প্রক্রিয়া। ঘাম না হওয়া কখনো কখনো বড় ধরনের অসুস্থতার লক্ষণ। তবে এর মধ্যেও কারো কারো দেখা যায় অতিরিক্ত ঘাম হচ্ছে। এই অতরিক্ত ঘামও সমস্যা তৈরি করে। আজ ১৬ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বারডেম হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, বিশিষ্ট চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. রেজা বিন জায়েদ।
প্রশ্ন : ঘামতো মানুষের শরীরে হয়ই এবং হতেই হবে। এটি অত্যাবশ্যকীয় একটি প্রক্রিয়া। বরং ঘাম না হওয়াই সমস্যা। বুঝতে হবে এটা বড় ধরনের অসুস্থতার লক্ষণ। তবে এর মধ্যে কারো কারো দেখা যায় এত বেশি ঘাম হয় সেটিও একটি সমস্যা। একজন মানুষের ঘাম হওয়াটা প্রয়োজন কেন এবং কী পরিমাণের বেশি দেখলে আমরা মনে করব তার অতিরিক্ত ঘাম হচ্ছে?
উত্তর : ঘাম শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শরীরের ভেতরে যে তাপমাত্রা আছে- এটি যাতে সহজে বের হয়ে যায় এবং ভেতরে বেশি গরম না হয়ে যায় সে জন্য ঘাম হয়। তার মানে হচ্ছে, ঘাম যখন হয় তখন শরীরের কিছু তাপমাত্রা নিয়ে সে বের হয়ে আসে এবং বাইরের আবহাওয়ায় এসে সেটা শুকিয়ে যায়। অনেকটা এয়ার কন্ডিশন পদ্ধতির মতো। বাইরের সঙ্গে ভেতরের তাপমাত্রা রক্ষা করা। এটা খুব প্রয়োজনীয়। কারণ আমাদের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা দরকার, যেটা আপনারা জানেন, ৯৮ দশমিক ৪ থেকে ৯৯ ফারেনহাইট পর্যন্ত থাকতে পারে। কিন্তু অতিরিক্ত তাপমাত্রা থাকলেই শরীরের ভেতরে যে কার্যকলাপগুলো থাকে সেগুলো ঠিকমতো হতে চায় না। মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়, অসুস্থ অনুভব করে। এমনকি বিছানায় পড়ে যায়। জ্বর হলেও হয় ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। সে জন্য ঘাম আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি প্রক্রিয়া।urgentPhoto
প্রশ্ন : যেটি জানতে চেয়েছিলাম, ঘামতো সাধারণত হবেই। তবে এটি কী পরিমাণ বেশি হলে তা অতিরিক্ত হচ্ছে বলা হবে?
উত্তর : সহজভাবে সবাইকে বুঝতে হবে, গরম আবহাওয়ার মধ্যে বা পরিবেশের মধ্যে যে যাবে তখনই ঘাম হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অতিরিক্ত ঘাম কাকে বলে? ওই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বা ওই তাপমাত্রায় অনেকে রয়েছে বেশি ঘামা শুরু করে। এই ঘামাটা আরম্ভ হয় বোগল এবং এর ভেতরের অংশগুলো যে ঢাকা থাকে এখানে ঘামতে শুরু করে। এমন অবস্থা হয় যে পরনের পোশাক ভিজে যায়। মুখ পর্যন্ত ভেজা আরম্ভ করে। ওই তাপমাত্রায় অন্যরাও ঘামছে বটে কিন্তু এ রকম নয়। তখন ধরে নিতে হবে স্বাভাবিক যতটুকু ঘাম হওয়ার কথা তার থেকে বেশি হচ্ছে।
প্রশ্ন : কারো কারো দেখা যায় শরীরের ঢাকা কিছু অংশ, বগলে অংশে এসব জায়গাতে বেশি ঘাম হয়। কারো কারো হাতের তালু প্রচণ্ড ঘামে। এত বেশি ঘামে যে লিখতে গেলে কাগজ ভিজে যায়। কারো দেখা যায় মাথাটা বেশি ঘামে। কারো আবার মাথার পেছনের দিকটা ঘামে – এর কারণ কী?
উত্তর : আসলে ঘামের রোগ যাদের আছে তাদের আমরা দুইভাগে ভাগ করি। একটা হচ্ছে নির্দিষ্ট জায়গায় অতিরিক্ত ঘামে। যেমন হাত-পা ঘামা আপনি বলছিলেন বা মাথার পেছনটা ঘেমে যাচ্ছে বা মুখটা ভিজে যাচ্ছে এটা হচ্ছে লোকালাইজড হাইপার হাইড্রোসিস। হাইপার হাইড্রোসিস মানে হচ্ছে অতিরিক্ত ঘাম।
আরেকটি ভাগ আছে এটি হচ্ছে জেনারালাইজড হাইপার হাইড্রোসিস। এটা নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নয় সারা শরীর ভিজে জব জব করছে।
ঘাম সাধারণত ভেতরের রোগের কারণও হয়। যাদের থাইরোয়েড রোগ আছে তারা অতিরিক্ত ঘামে। কিছু কিছু ওষুধ খাওয়ার কারণেও ঘাম হয়। অন্যান্য অনেক রোগ আছে, যেমন যেটার জন্য অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে। যেমন, ক্যানসারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
আবার অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই ঘাম হয়। একে অনেক সময় ইডিওপেথিক বলে। হাত পা ঘামে, এটি অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই। কেউ কেউ একটু স্নায়বিক চাপে পড়লেও ঘেমে যায়।
আসলে ঘামের বিভিন্ন সময় আছে। শুধু যে গরম বা আর্দ্র আবহাওয়ায় ঘামবে তা নয়। কেউ কেউ আছে খাবার সময় অতিরিক্ত ঘামে। কেউ আছে পরীক্ষার হলে বসে অতিরিক্ত ঘামে বা মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে বসে অতিরিক্ত ঘামতে থাকে। এগুলো সব স্নায়ুজনিত ঘাম।
প্রশ্ন : খাওয়ার সময় মুখমণ্ডল এলাকায় অনেকে ঘামে। আপনি বলছিলেন কোনো রোগ ছাড়া এমনিতেও কেউ বেশি ঘামতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কোনো রোগের কারণেও ঘামতে পারে। সে জন্য অতিরিক্ত ঘাম হলে তার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঠিক করা উচিত। যদি কোনো রোগের কারণে ঘাম না হয়, এমনিতেই যদি ঘামতে থাকে তাতে অসুবিধা কী?
উত্তর : অতিরিক্ত ঘামতে থাকলে অসুবিধা তো বিব্রতকর অবস্থা। যেমন, হয়তো সবাই এক জায়গায় আছে এর মধ্যে একজন বেশি ঘামছে, বারে বারে ঘামছে এবং ঘাম মোছার জন্য চেষ্টা করছে।
ঘাম অতিরিক্ত হলে এর কারণে জামা কাপড়ে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। এটাকে আমরা বলি ব্রম হাইড্রোসিস। অর্থাৎ অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে দুর্গন্ধ হওয়া।
প্রশ্ন : ত্বকের রোগ কী হতে পারে অতিরিক্ত ঘামের কারণে?
উত্তর : অতিরিক্ত ঘামের কারণে ছত্রাক জনিতরোগগুলো খুব সহজে হয়ে যায়। আমাদের শরীরে যে সাদা সাদা ছুলি হয় এটা অতিরিক্ত ঘামের কারণেই হয়। অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে অনেক সময় ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হয়ে যায়। এতে শরীরে লবণের পরিমাণ কমে যায়। এটার পাশ্বর্প্রতিক্রিয়াগুলো আসতে থাকে।
প্রশ্ন : কোনো ব্যক্তি যখন অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া সমস্যা নিয়ে আপনাদের কাছে আসে তখন আসার পর কীভাবে নির্ধারণ করেন এটি কোনো রোগের কারণে হচ্ছে না সাধারণ ভাবে হচ্ছে?
উত্তর : প্রথমে আমরা রোগী যে ঘামছে এই বিষয়ে কী কী অভিযোগ করছে তা গুরুত্ব দেই। তারপর জিজ্ঞেস করি এটি শরীরের কোনো অংশ থেকে হচ্ছে কি না। আমরা যখন দেখি এটি নির্দিষ্ট অংশে হচ্ছে তখন লোকাল হাইপার হাইড্রোসিস বলে নেই। আর সারা শরীরে হলে জেনারালাইজড।
এর পরীক্ষা নীরিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। জেনারালাইজড হলে আমরা থাইরোয়ের কোনো সমস্যা আছে কি না সেটি নির্ণয়ের পরীক্ষায় যাই। একটু আগেই বলছিলাম, থাইরোয়েডের সমস্যায় এমনটা হতে পারে।
তা ছাড়া কিছু পাউডার আছে ওটা শরীরে মেখে দিলে ঘাম লাগার সঙ্গে সঙ্গে ওটার রং পরিবর্তন হয়। তা দেখে আমরা বুঝতে পারি। ঘামের পরিমাণটা কী রকম এবং কোন কোন জায়গা থেকে অতিরিক্ত ঘাম হচ্ছে।
প্রশ্ন : এটি প্রতিকারে করণীয় কী?
উত্তর : লোকালাইজড যদি হয়, ধরুন হাত-পা ঘামছে, তাহলে হাত-পা ঘামার জন্য বিশেষ চিকিৎসা আছে। অ্যালুমোনিয়াম ক্লোরাইড নামে এক ধরনের উপাদান আছে সেটি দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হাত-পায়ের ঘাম বন্ধ করা সম্ভব। কোনো কোনো সময় ইনজেকশন দিয়েও হাত-পা ঘামা বন্ধ করা যেতে পারে। এটি দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিছু সার্জারি আছে, করলে স্থায়ীভাবে লোকালাইজড ধরনের ঘামা বন্ধ করা যায়। এটা নির্ভর করে হাত-পা ঘামার পরিমাণ কেমন, কতটুকু, তার অসুবিধা হচ্ছে কি না- তার ওপর।