ক্রনিক কিডনি রোগী রোজা রাখবেন কীভাবে
রোজা চলছে। রোজার সময় কিডনি রোগীরা, বিশেষ করে ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর আছে যাঁদের, তাঁরা রোজা রাখতে পারবেন কি না-এ বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে। আজ ২০ জুন ২০৭২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের কিডনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক।
প্রশ্ন : সিকেডি বা ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর রোগটি কী?
উত্তর : কিডনি ফেইলিউর বা কিডনির কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা দুই ধরনের হয়। একটিকে বলি হঠাৎ কিডনি ফেইলিউর এবং দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ফেইলিউর। এই দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ফেইলিউরকে ক্রনিক কিডনি রোগ বলা হয়। আর তিন মাসের কম সময় যদি ফেইলিউর থাকে, তাকে বলি হঠাৎ কিডনি ফেইলিউর বা একিউট কিডনি ফেইলিউর। আর দীর্ঘমেয়াদি হলো, যেটা তিন মাসের বেশি সময় ধরে থাকে।
রোজার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি ফেইলিউর রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন, তবে তাদের বিশেষ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
প্রশ্ন : একজন মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয় কেন? একজন মানুষের কিডনি ধীরে ধীরে বিকল হওয়ার দিকে যায় কেন? বিস্তারিত বলুন।urgentPhoto
উত্তর : একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের প্রথম কারণ নেফ্রাইটিস। এটা প্রায় ৪০ ভাগ। এরপরেই আসে ডায়াবেটিস। তারপরে উচ্চরক্তচাপ এবং বারবার যে ইউনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন হয়-এসব কারণে এই রোগ হতে পারে।
আর কিছু পরিবারগত কারণ আছে। যেমন : কিছু পলিসিস্টিক কিডনি রোগ আছে। আর কিছু রয়েছে অজানা কারণ।
আমাদের দেশে নেফ্রাইটিস এই রোগের বড় কারণ। এবং উন্নত বিশ্বে ডায়াবেটিস এই রোগের একটি বড় কারণ। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
প্রশ্ন : সিকেডির সঙ্গে কি বয়সের কোনো বিষয় আছে? বয়স বেশি হলে এই রোগের আশঙ্কা বাড়ে। নাকি যেকোনো বয়সে এই সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : আমি যে কারণগুলো বললাম, তা যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে ধরুন নেফ্রাইটিস হয়ে সিকেডি হবে। তবে নেফ্রাইটিস হলেই সঙ্গে সঙ্গে সিকেডি হবে না। হয়তো চার বছর বা ছয় বছর সময় লাগে।
যদি ডায়াবেটিসের কারণে সিকেডি হয় তবে কমপক্ষে ১০ বছর লাগে। কাজেই দেখা যায় সাধারণত বয়স্ক লোকদের এই সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : একজন মানুষ যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন এবং এটা দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক হয় এই চলতে থাকা অবস্থায় তার কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে বা কী সমস্যা দেখলে সে বুঝবে তার কিডনির সমস্যা হয়েছে?
উত্তর : দুটোর কিডনির একটি রিজার্ভ ফাংশন আছে। বলা হয়ে থাকে দুটো কিডনির ৭০ ভাগের বেশি অকার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। এটা আমাদের জন্য সাংঘাতিক একটি কষ্টের ব্যাপার। তাই আমরা আগেই রোগ নির্ণয় করতে পারছি না।
আমাদের একটি পরামর্শ, যাদের ডায়াবেটিস আছে বা হাইপার টেনশন আছে তারা যেন দুই মাস বা তিন মাস পরপর কিডনি ফাংশন টেস্ট করেন; যাকে আমরা ক্রিয়েটিনিন বলি।
তবে যদি উপসর্গ বলি, শুরুতে খুব একটা উপসর্গ পাওয়া যায় না। হয়তো দেখা যায় তার একটু দুর্বল লাগছে। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। এটা প্রাথমিক পর্যায়ে।
তারপর দেখা যায় তার প্রস্রাবের পরিমাণটা হয়তো কমে যাচ্ছে। পায়ে একটু একটু পানি আসছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল মুখটা ফোলা ফোলা লাগছে। তার আগে কখনো উচ্চ রক্তচাপ ছিল না। একদিন দেখা গেল হঠাৎ করে প্রেসার বেড়ে গেছে। এই যে ছোটখাটো বিষয়গুলো এগুলো যদি আমরা খুব খেয়াল করি তাহলেই আমরা বুঝতে পারব এর লক্ষণগুলো কী এবং রোগ নির্ণয় করতে পারব।
প্রশ্ন : শরীরের যে অঙ্গগুলো অত্যাবশ্যকীয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কিডনি। সে জন্য এর রোগ হলে আমরা বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আপনি বলছিলেন লক্ষণ প্রকাশ পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। চিকিৎসা করে কি ভালো করা যায়? এই রোগ চিকিৎসায় কী করা হয়?
উত্তর : কিছুটা তো আতঙ্কগ্রস্ত হতেই হয়। সিকেডি মানে হচ্ছে এটি আর সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসবে না। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেছে। বলা হয় বিরামহীনভাবে এটি এমন একটি অবস্থায় যাবে, যখন তার ডায়ালাইসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হবে। তবে আপনি যদি আগে রোগ নির্ণয় করেন, তবে অনেকটা ঠিক রাখা সম্ভব। সিকেডিকে আমরা পাঁচটা ভাগে ভাগ করি। পর্যায় ১ বা ২-তে যদি আমরা রোগ নির্ণয় করতে পারি তাহলে এই রোগীটা ডায়ালাইসিসে যেতে অনেকটা সময় আমরা দেরি করাতে পারি। আমাদের উদ্দেশ্য থাকে, আমরা ভালো করতে পারব না সেটা জানি। কিন্তু খুব দ্রুত যাতে একদম শেষ পর্যায়ে না যায়। যদি আগে থেকে নির্ণয় করা যায়, তাহলে ১০ -১৫ বছরেও সে খুব ভালো থাকবে। কাজেই অতটা আতঙ্কিত না হলেও চলবে।
প্রশ্ন : কিডনি রোগে যাঁরা আক্রান্ত, তাঁদের মধ্যে কারা কারা রোজা রাখতে পারবেন? কাদের বেলায় রোজা রাখতে হলে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন এবং কাদের বেলায় রোজা রাখা আসলেই আরো ক্ষতিকর হবে?
উত্তর : ক্রনিক কিডনি রোগের যেই পর্যায় আমি আপনাকে বললাম, পর্যায় ১, ২, ৩ পর্যন্ত মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই রোজা রাখতে পারবেন। শুধু তাঁরা ইফতারে প্রচুর পরিমাণে পানি বা লবণ জাতীয় খাবার না খান। যেমন আমাদের প্রচলিত আছে ইফতারে ছোলা, পেঁয়াজু না হলে আমাদের চলে না। এই খাবারটা তিনি খেতে পারবেন না।
প্রশ্ন : তাহলে কী খাবে?
উত্তর : চিঁড়া ভিজিয়ে টকদই খেতে পারেন। মুড়ি খাওয়া যেতে পারে। নুডলস করে খাওয়া যেতে পারে। সেমাই খাওয়া যেতে পারে। এমনকি ভাত বা রুটিও খেতে পারে। কিডনি রোগীরা যা খেতে পারেন তাই খেতে পারবেন।
প্রশ্নন: আপনি বলছিলেন কিডনি রোগীর একপর্যায়ে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। রোজা রেখে কি ডায়ালাইসিস করা যাবে। কিংবা ডায়ালাইসিসের রোগীরা কি রোজা রাখতে পারবেন?
উত্তর : এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কারণ হলো ডায়ালাইসিস যখন আমরা করতে যাই, তখন রোজা ঠিক থাকে না। আরেকটি কথা হলো ডায়ালাইসিসের রোগীও রোজা রাখতে পারবেন, তবে যেদিন ডায়ালাইসিস করা হবে সেদিন না। তার আগের দিন বা পরের দিন রাখতে পারবেন। তবে আগেই বলেছি তাঁর খাবারদাবারে সতর্ক থাকতে হবে। পানি কতটুকু খাবেন সেদিকে খেয়াল রাখবেন, লবণ বা পটাশিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়ার বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।
প্রশ্ন : একটি প্রচলিত বিষয় আছে, কিডনি রোগ দূর করার ক্ষেত্রে প্রচুর পানি খেতে হয়। এর মানে কী?
উত্তর : না, বিষয়টি আসলে ঠিক নয়। আমি যদি দুই লিটার, পাঁচ লিটার পানি খেলাম বিষয়টি আসলে সে রকম না। পানি খাবেন, যখন আপনার প্রয়োজন হবে। কাজেই সাধারণত আমরা দুই লিটার বা আড়াই লিটার এটিই যথেষ্ট। কিন্তু প্রচলিত যে ধারণা বেশি পানি পান করলে আমার কিডনিতে কোনো রোগ হবে না এটা ভুল।
প্রশ্ন: একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের কতটুকু পানি খাওয়া উচিত?
উত্তর : দুই লিটার বা তিন লিটার।
প্রশ্ন : এ বছর তো রোজার সময় প্রায় ১২ ঘণ্টা। এক্ষেত্রে পানি কীভাবে খেতে হবে। অন্য সময় তো আমরা ভাগ করে এক গ্লাস, বা দুই গ্লাস খাই...
উত্তর : খেতে পারবে। কারণ ফাস্টিং টাইম ১২ ঘণ্টা হলেও সাধারণ দিনেও যখন আমরা রোজা রাখি না, তখনও ফাস্টিং সময় ১২ ঘণ্টা হয়। কেবল সময়টাকে যদি আপনি উল্টে চিন্তা করেন, রাতে সেই পানিটুকু খাবে, ইফতারের পরে খাবে। তারাবির পরে খাবে।
প্রশ্ন : কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের কতটুকু পানি পান করা প্রয়োজন?
উত্তর : আমরা বলি, যারা সাধারণত কিডনি রোগে আক্রান্ত তাদের পানি শরীর থেকে বের হবে কম, ইউরিনটা বের হবে কম। এ জন্য ছোট পদ্ধতি বলে দিই, আপনি দেখবেন প্রস্রাবটা প্রতিদিন কতটুকু পরিমাণে হয়। ধরুন এক লিটার প্রস্রাব হচ্ছে, আমরা তার সঙ্গে আর আধা লিটার যোগ করে দিয়ে পান করতে বলি। তার মানে আপনি দেড় লিটার পানি খাবেন।
কারো যদি প্রস্রাব আধা লিটার হয়, তবে সে এক লিটার পানি পান করবে। তবে দেখতে হবে তার পায়ে পানি জমে যায় কি না। পা টা ফুলে যায় কি না। যদি পা ফুলে যায়, তাহলে বাড়তি আধা লিটার যোগ করা হয় না। যতটুকু প্রস্রাব হবে ততটুকু পানি খেতে বলব। এ ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়াই ভালো।