জ্বর হলেই মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালবেন না
বিভিন্ন কারণে জ্বর হয়। জীবনে জ্বর হয়নি এ রকম মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে জ্বর হলেই অনেকে নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন এবং পূর্ণ মাত্রায় কোর্স সম্পন্ন করেন না। এ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যক্ষমতা হারায়। ৮ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯০তম পর্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবদুল জলিল চৌধুরী।
urgentPhoto
প্রশ্ন : জ্বর একটি লক্ষণ। তবে জ্বর বিভিন্ন ধরনের হয়, রকমফের আছে। খুব সাধারণ সর্দিজ্বর থেকে গুরুতর কারণেও জ্বর হতে পারে। সাধারণত কী কী ধরনের জ্বর হয়?
উত্তর : আপনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন, জ্বর কোনো অসুখের নাম নয়। জ্বর কোনো একটি অসুখের লক্ষণ। জ্বরকে আমরা এভাবে ভাগ করি, অল্প সময়ের জন্য জ্বর। আবার দীর্ঘমেয়াদি জ্বর। কিছু জ্বরের চিকিৎসা করলেও ভালো হয়। কিছু জ্বর না চিকিৎসা করলেও ভালো হয়। স্বল্পকালীন জ্বর যেগুলো আছে, যেমন, ভাইরাল ফিভার, যেটাকে আমরা ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা বলি। আর দীর্ঘমেয়াদি জ্বর বা মাঝামাঝি জ্বরগুলো হচ্ছে, ম্যালেরিয়া টাইফয়েড, টিবি, কালাজ্বর। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, মেয়েদের প্রস্রাবে ইনফেকশন এগুলো স্বল্পমেয়াদি হতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। আবার কোনো কোনো জ্বর আছে বারবারে হতে পারে।
প্রশ্ন : যেকোনো কারণেই হোক একজনের এ রকম জ্বর আসল, জ্বর এলে প্রাথমিক অবস্থায় একজন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে মানুষের করণীয় কী? এবং কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে তার অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। অথবা কারো জ্বর এসেছে, সে চিকিৎসা নিল। এরপর ও হঠাৎ করে জ্বর বেড়ে গেল, তখন তার করণীয় কী? –একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন...
উত্তর : প্রথমে দেখতে হবে জ্বর হওয়ার প্রধান কারণ কী। আমাদের দেশের জ্বরের প্রধান কারণ হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা, ফ্লু। যদি ঋতুর ভিন্নতার কারণে হয়। যদি এর সঙ্গে নাক দিয়ে পানি পড়ে, সর্দি হয়, চোখ একটু জ্বালপোড়া করে, নাকে পানি পড়ে, মাথা ব্যথা হয় এবং দুদিন ধরে হয়তো জ্বর থাকল তাহলে সাধারণত একে ফ্লুই মনে করি। তবে সব জ্বরই যে ফ্লু হবে সেটা নাও হতে পারে। যদি সিলেটে কোনো রোগীর জ্বর হয় সে প্রথমেই ম্যালেরিয়ার চিন্তা করে। রাজশাহী বা ময়মনসিংহ অঞ্চলে জ্বর মানেই মনে করা হয় কালাজ্বর। তবে ঢাকা শহরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বর সর্দি, কাশি , ফ্লু হয়- যেই জ্বরই হোক প্রথমে তিনদিন হয়তো চিকিৎসকের কাছে যাওয়া লাগে না। ঘরেই চিকিৎসা করা সম্ভব। যদি জ্বর এলে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, চোখে ঘোলা লাগে দেখতে, বমি হয়- এ রকম হলে সেদিনই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া লাগতে পারে। তবে সামান্য জ্বর, মাথা ব্যথা, সর্দি- এগুলোতে চিকিৎসকের কাছে প্রথমে দু-তিনদিন না গেলেও চলে।
প্রশ্ন: সেই ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কি প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে পারে?
উত্তর : আমার তো মনে হয় প্যারাসিটামল খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণত আপনি যখন জ্বর হওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে যাবেন তখন তিনি ভাববেন আপনি একে ভয়াবহ মনে করছেন। চিকিৎসকও ঝুঁকি নেবেন না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনাকে দিয়ে দেবেন। এমনকি আপনাকে বলতে পারেন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য।
তাই লক্ষণ বা ধরন দেখে আপনি এটাকে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন সেটা বিবেচনা করতে হবে। আপনি জানেন জ্বর যখন হয়, তখন শরীরে একটি কাঁপুনি হয়। এর মানে জ্বর আসছে। জ্বর যখন আসে, শরীরের রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়। তাপ তখন শরীরে ধরে রাখে এবং জ্বর আসে। যখন যদি শরীরে ঠান্ডা পানি লাগাই, তখন আরো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবে।
তাই কোনো অবস্থায় শরীরে ঠান্ডা পানি লাগানো যাবে না। টেপিড স্পনজিং অর্থাৎ কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে শরীরে স্পঞ্জ করতে হবে। যেন রক্তনালিগুলো প্রসারিত হতে পারে এবং জ্বর ছাড়তে পারে। ঠান্ডা পানি দিয়ে কখনো শরীর মোছা ঠিক না। মাথায়ও ঠান্ডা পানি ঢালা ঠিক না। এতে আরাম লাগে ঠিকই, তবে জ্বরের পর যে কাশি হবে সেটা দূর করা কঠিন হবে।
প্রশ্ন: অনেকে যে ঠান্ডা পানিতে কাপড় দিয়ে জল পট্টি দেয় এটা...
উত্তর : জলপট্টি দিলে আসলে ক্ষতি হওয়ার কথা না। এটা করা যেতে পারে। কিন্ত মাথায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি ঢাললে কাশি হয়ে যায়। সেই কাশি সহজে ভালো করা মুশকিল। এটা এড়িয়ে যাওয়া ভালো। করতে চাইলে স্বল্পক্ষণের জন্য করা যেতে পারে, এর বেশি না। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দুই থেকে চারবার করে প্যারাসিটামল খেলে তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
প্রশ্ন : অনেকে আছেন, যাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন এবং পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করা প্রয়োজন সেটি করেন না। আবার কেউ টেলিফোনের মাধ্যমে চিকিৎসক বা অন্য কারো কাছ থেকে ওষুধ শুনে নিয়ে খান। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তর : অ্যান্টিবায়োটিক এভাবে খাওয়া একেবারেই ঠিক না। এখন আমাদের দেশে বিদেশের চেয়ে ওষুধ অনেক সস্তা। যেকোনো জায়গায় বললেই এখন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেয়। এখন অনেকেই জ্বর আসার দিনই অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দেন। যেটা অবশ্যই বর্জনীয়। বেশির ভাগ ভাইরাল ফিভারের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। আর যদি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া হয় এবং পূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন না করা হয়, তখন এটি আর পরবর্তী সময়ে তেমনভাবে কাজ করে না। তখন আমাদের জন্য অন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন রোগ শনাক্ত করাও কষ্ট হয়ে যায়।
টেলিফোনে ব্যস্ত চিকিৎসক লক্ষণ শুনে ওষুধ লিখতে অনেক্ষণ সময় লেগে যায়, তখন হুট করে একটি ওষুধের নাম বলে দেয়। আপনি সেটা হয়তো খান। আবার খেলেও হয়তো সম্পূর্ণ ওষুধ শেষ করেন না। এ ধরনের ব্যস্ত চিকিৎসকের কাছে টেলিফোন করে ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। তবে কিছু কিছু কল সেন্টার থাকে তারা বসে থাকে আপনার কথা শোনার জন্য, সেখানে হয়তো আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। তবে কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছে শুনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া ঠিক নয়। সর্বোত্তম হচ্ছে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দেখিয়ে চিকিৎসা নেওয়া।