রক্তপাত হলে কি রোজা ভাঙে?
রোজায় সময় মুখ ও দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সময় রক্তপাত হয়। অনেকেই ভাবেন এই সময় এ ধরনের চিকিৎসাগুলো নেওয়া ঠিক হবে কি না। আজ ৯ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯১ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজারভেটিভ ডেনট্রিসট্রি এবং এন্ডোডনট্রিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম বাশার।
প্রশ্ন : সাধারণত দাঁতের সমস্যা অনুযায়ী বিভিন্ন চিকিৎসা হয়ে থাকে। এই চিকিৎসাগুলো যেসব রোগী নেন তাঁদের মধ্যে কিছু প্রশ্ন জাগে এগুলো রোজায় করানো ঠিক হবে কি না। প্রথমে একটু বলুন মুখে সাধারণত কী ধরনের রোগ হয়?
উত্তর : দাঁত এবং মুখের রোগের মধ্যে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে দন্ত ক্ষয় বা ক্যারিজ। আর আমাদের এই এশীয় অঞ্চলে বা বাংলাদেশে আরেকটি বড় ধরনের রোগ হচ্ছে মাড়ির প্রদাহ বা জিনজিভাইটিস। এ দুটো রোগ হচ্ছে দাঁতের বেশির ভাগ রোগের প্রধানতম কারণ। আর পরবর্তীকালে এর ফলে অন্যান্য রোগ হয়। যেমন : পালপাইটিস, দাঁতের মজ্জার প্রদাহ– এটাও দাঁতের ক্ষয় থেকে হয়। যে কারণে আমরা রুট ক্যানেল করি। এটা দাঁতের ক্ষয়েরই পরবর্তী অবস্থা।
এ ছাড়া দাঁতের মাড়ি নড়ে যাওয়া, দাঁত নিজে সরে যাওয়া- এগুলো আবার একইরকমভাবে মাড়ির প্রদাহ বা জিনজিভাইটিসের পরবর্তী অবস্থা।
এর কারণে মুখ অনেক সময় ফুলে যায় বা শরীরের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া মুখের ঝিল্লির মধ্যে ক্ষত হওয়া, ঘা হওয়া সেটিও হতে পারে। আমাদের এশীয় অঞ্চলে এই ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
পান, সিগারেট, জর্দা এসব জিনিস ব্যবহার করার কারণে দেখা যায় মুখের ঝিল্লির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঘা হয়ে থাকে। এটাও দাঁতের রোগের একটি বেশ বড় কারণ।
প্রশ্ন : মুখ বা দাঁতের এই ধরনের সমস্যায় আপনারা সাধারণত কী ধরনের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : সাধারণভাবে একটা দাঁতের ক্ষয়ের জন্য ফিলিংই যথেষ্ট। যদি না এর ভেতরে কোনো ধরনের ব্যথা তৈরি হয়ে থাকে। অথবা শিরশির অনুভূতির মাত্রা বেশি হয়ে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফিলিংই যথেষ্ট। যদি শির শিরের মাত্রা বেশি হয়,যে ঠাণ্ডা পানিতে অতিরিক্ত শির শির করছে, বেশ কিছু সময় ধরে বজায় থাকছে, কিংবা খুব তীব্র ব্যথা হচ্ছে, অথবা মাঝে মাঝেই ব্যথা হয় । কিংবা দাঁতের গোড়া ফুলে যায়। এসব ক্ষেত্রে রুট ক্যানেল চিকিৎসা করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষ রুট ক্যানেলের কিছু সাহায্যকারী চিকিৎসাও করা হয়।
আর মাড়ির রোগের ক্ষেত্রে প্রধানতম চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে দাঁতের স্কেলিং। মাড়ির মধ্যে জমে থাকা পাথরগুলোকে পরিষ্কার করে দেওয়া এবং যত্ন নেওয়া। এর পাশাপাশি পরবর্তী অবস্থার জন্য মাড়ির বিশেষ ধরনের সার্জারি দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : কখনো কী দাঁত ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে?
উত্তর : বর্তমানে দন্ত্য চিকিৎসা বিজ্ঞান এত উন্নত যে সাধারণভাবে এর প্রয়োজন পড়ে না। তবে এর পরও যদি দাঁত অতিমাত্রায় নড়ে গিয়ে থাকে কিংবা দাঁত এমনভাবে ভেঙেছে যে একে আর পুনরায় তৈরি করা সম্ভব না তখন সেই ক্ষেত্রে দাঁত ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অথবা দাঁত হয়তো সংক্রমণ হয়ে এমন অবস্থায় এসেছে যে রেখে দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। তখন ফেলে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : এসব চিকিৎসার ক্ষেত্রে একজন রোজাদার কোন পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে?
উত্তর : আসলে দাঁত এবং মাড়ির রোগের সব চিকিৎসাই রোজা রেখে নেওয়া সম্ভব। দাঁতের চিকিৎসায় চিকিৎসা অনুসারে দুটো ঘটনা ঘটে। একটা সমস্যা হলো, এসব চিকিৎসা যেখানে রক্তপাত হয়। আর ওই সব চিকিৎসা যেখানে সাধারণভাবে রক্তপাত হয় না সেখানে আমাদের দাঁতের যে ফিলিং করার যন্ত্রটা আছে সেটা থেকে পানি বের হয়। এই পানি অনেকের ক্ষেত্রে সমস্যা মনে হতে পারে। তবে এর বিষয়টি তো এ রকম যেমন কেউ ওজুর জন্য মুখে পানি নিল। তার পর ফেলে দিল। সে যতক্ষণ পর্যন্ত পানি না গিলল ততক্ষণ পর্যন্ত তো রোজাটা ভাঙবে না। সেই অর্থে ওই সব চিকিৎসা যেমন ফিলিং, পাল্প ক্যাপিং এ ধরনের কিছু চিকিৎসা যেখানে রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে না, এমনকি রুট ক্যানেল চিকিৎসা এগুলো সহজেই রোজা রেখে করে নেওয়া সম্ভব।
তবে যেসব চিকিৎসায় রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যেমন দাঁত তোলা অথবা স্কেলিং- এই ধরনের চিকিৎসাগুলোর ক্ষেত্রে মুফতি সাহেবরা যেটা বলেন, আসলে রক্তপাত হওয়ার কারণে রোজা ভাঙে না। এমনকি যদি কেউ রক্ত দেয়ও এর কারণে রোজা ভাঙে না। তবে যদি রক্ত কেউ খেয়ে ফেলে তাহলেই কেবল রোজা ভাঙতে পারে। তাই যেসব চিকিৎসায় রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সেসব ক্ষেত্রে যদি গলার ভেতর রক্ত চলে না যায় বা গিলে না ফেলে তাহলে রোজা ভাঙার আশঙ্কা থাকে না। তারপরও মুফতি সাহেবরা এটা বলে থাকেন, এসব চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটা উত্তম যে রোজা রাখা অবস্থায় যদি জরুরি অনুভব করে তাহলে সে চিকিৎসা করাল। অথবা ইফতারের পর সে এই চিকিৎসাগুলো নিতে পারে।
আর আরেকটি বিষয় হলো ওষুধ ব্যবহারে, যেমন, মুখের ঘায়ের ক্ষেত্রে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় এটা শুধু ইফতারের পরে বা রাত্রের খাওয়ার পর যদি সে ব্যবহার করে তাহলে এই চিকিৎসাগুলো করা সম্ভব।
প্রশ্ন : রক্তপাত হলে রোজা ভাঙে না- এই বিষয়ে একটু পরিষ্কার হতে চাই, এটা কী মুখের রক্তপাত হলে সেটি, নাকি শরীরের যেকোনো অংশ থেকে রক্তপাত হলে রোজা ভাঙে না? আমরা তো জানি যে, রক্ত যদি ফিনকি দিয়ে পড়ে তাহলে রোজা ভেঙে যায়?
উত্তর : মুফতি হেমায়েতুল ইসলাম সাহেব, মুফতি সাইদ আহম্মেদ সাহেব উনারা অন্যান্য ফতোয়ার কিতাবগুলোর সমস্বয়ে এটাই বলছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে রোগী, ডাক্তার এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নামে একটি বইয়ের মাধ্যমে, আমাদের প্রয়োজনে অনেক সময় রক্ত দেই বা রক্ত নেই, যেখানে আমাদের শরীর থেকে প্রায় ৫০০ এম এল পরিমাণ রক্ত বের হয় এবং ৫০০ এমএল পরিমাণ রক্ত শরীরে ঢোকে- আসলে এর দ্বারা রোজা ভাঙার কোনো কারণ ঘটে না। তবে রক্ত দেওয়ার কারণে যদি কারো অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে তার জন্য এটা মাখরু হয়ে যায়। অর্থাৎ এতে রোজা দুর্বল হয়, তবে রোজা ভাঙে না।
প্রশ্ন : আবার চিকিৎসার বেলায় আসি। অনেকে মনে করেন, মুখে ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে এর ফলে রোজা ভাঙতে পারে। আসলেই কী ইনজেকশন দিলে রোজা ভাঙে কি না?
উত্তর : আসলে যেকোনো ধরনের ইনজেকশন, বিশেষ করে যদি এটা শক্তি বর্ধক না হয় এটা রোজা রাখা অবস্থায় দেওয়ার যায় বলেই মুফতি সাহেবরা বলে থাকেন। এটা কেবল মুখের রোগের জন্য ব্যবহৃত ইনজেকশন তাই নয় যেমন এনেসথেটিক ইনজেকশন বা ব্যথানাশক ইনজেকশন আমরা দই- এটা রোজা রাখা অবস্থায়ও দেওয়া যায় বলে মুফতি সাহেবরা বলেন।
প্রশ্ন : দাঁতের চিকিৎসার বেলায় সাধারণত একটি ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়, পাশাপাশি গ্যাসট্রিকের সমস্যা যাতে না হয় সেই জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। গ্যাসট্রিকের ওষুধের বেলায় বেশিভাগ ক্ষেত্রেই এ রকম থাকে যে খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে খালি পেটে খেতে হবে। রোজার সময়তো খালি পেটে খাওয়া সম্ভব নয়। তখন এর সমাধান কী?
উত্তর : এটাতো খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব ইফতারের সময় হয়তো সে ওষুধটা খেয়ে নিল এর পর নামাজ পড়ল পড়ে বাকি অংশগুলো শেষ করল। আবার সেহেরির সময় যদি কেউ আগে উঠে ওষুধটা খেয়ে নেয় এটাও সম্ভব।
আবার কিছু কিছু ওষুধ এখন বাজারের পাওয়া যায় যেগুলো খাবার আগে বা পড়ে খাওয়ার সাথে কার্যকারিতায় তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। সুতরাং এ ধরনের ওষুধগুলো এসিডিটি নিয়ন্ত্রণের জন্য রোজার মধ্যে খাওয়া যেতে পারে।