হেপাটাইটিস বি ও সি : রক্তগ্রহণে সতর্ক থাকুন
হেপাটাইটিস বি ও সি বেশ জটিল ধরনের রোগ। এর চূড়ান্ত লক্ষণ লিভার সিরোসিস। তবে কিছু প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নিলে এ রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। আজ ১৪ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম আজম।
প্রশ্ন : হেপাটাইটিস বি ও সি বিষয়টি আসলে কী?
উত্তর : হেপাটাইটিস অর্থ লিভারের প্রদাহ । হেপাটাইটিস বি হলে এক ধরনের ইনফেকশন হয়, সি হলে আরেক ধরনের ইনফেকশন হয়। বি-কে আমরা বলি ডিএনএ ভাইরাস। আর সি হলো আরএনএ ভাইরাস। ভাইরাসের সাপেক্ষে এ দুটো নামকরণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন : এই হেপাটাইটিস বি এবং সি দুটোর আচরণগত এবং লক্ষণগত কী প্রকাশ রয়েছে?
উত্তর : আমরা যখন এ দুটোর ইতিহাস নেই রোগীকে আলাদা করার কোনো উপায় নেই। তবে অনেক ফ্যাক্টরের কথা আমরা রোগীকে প্রশ্ন করার সময় জিজ্ঞেস করি। হেপাটাইটিস সি যেভাবে একজন মানুষের কাছ থেকে আরেকজন মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করে সেটা প্রচলিত। যেমন : দূষিত কোনো সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করলে। রক্ত যদি দেওয়া লাগে তখন যদি রক্তদাতার এই ধরনের সমস্যা থাকে। স্যালুনে গেলে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, কিংবা ডেন্টাল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে যদি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করা হয় তাহলে হেপাটাইটিস বি বা সি একইভাবেই বিস্তার লাভ করে।urgentPhoto
আর লক্ষণের কথা যদি বলেন তাহলে আলাদাভাবে বলার উপায় তেমন নেই। কারণ এর একই রকম লক্ষণ আসে।
প্রশ্ন : একই রকম বলতে কী কী ধরনের?
উত্তর : আসলে হেপাটাইটিস বি বা সি কে আমরা নীরব ঘাতক বলি। প্রাথমিকভাবে কার দেহে বি বা সি ভাইরাস আছে তার বোঝার কোনো উপায় থাকে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তার লিভারটা আক্রান্ত হয়ে কোনো রকম রোগের লক্ষণ না প্রকাশ পায়। এখন কথা হচ্ছে আমরা তাহলে বুঝি কীভাবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। কেউ হয়তো ব্লাড ডোনেট করতে যাবে তখন স্ক্রিনিং টেস্ট করলে ধরা পড়বে। কেউ হেপাটাইটিস বি-এর টিকা নিতে যাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ে। কোনো নারীর হয়তো গর্ভধারণ করার সময় বিষটি স্ক্রিনিং টেস্ট হিসেবে ধরা পড়ে। কেউ বিদেশে যাবে রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে হয়তো ধরা পড়ে। তার মানে অন্য একটি কারণে স্ক্রিনিং করতে গেছে তখন হয়তো ধরা পড়ছে ভাইরাসটা।
প্রশ্ন : এ জাতীয় সমস্যা হলে রোগী এবং তার আশপাশের আত্মীয় স্বজন অনেকটাই ভেঙে পড়েন মানসিকভাবে। সে ক্ষেত্রে আপনারা কীভাবে তাদের আশস্ত করেন এবং চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : এই ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি এবং সি কে আলাদা করে বলতে হবে। কেননা এই ধরনের ইনফেকশনে চূড়ান্ত পরিণতি দুটোর ক্ষেত্রে দুই রকম। দুটো ক্ষেত্রেই লক্ষণ প্রকাশ পায় যখন লিভার সিরোসিস বা রোগটি ক্রনিক পর্যায়ে চলে যায়। হেপাটাটিস বি-এর ক্ষেত্রে খুব দ্রুতই লিভার আক্রান্ত হতে পারে। ৫ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে লিভারটি চূড়ান্ত আক্রান্ত হয়ে সিরোসিস হতে পারে।
হেপাটাইটিস সি এর ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ বছর সময় লাগে। অতএব আমরা যদি বয়স চিন্তা করি তবে তরুণদের ক্ষেত্রে রোগের জটিলতা আমরা পেয়ে যাই। যদি কারো ছোট বেলায় এটা হয় তাহলে ২০ বা ২৫ বছরে সব লক্ষণ চলে আসে। আর সি ভাইরাসের ক্ষেত্রে একটু দেরিতে হয়। ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এই সমস্যা হয়। আর এই দুটো অসুখের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে লিভার সিরোসিস। আর সিরোসিস হলে এই সংক্রান্ত যে জটিলতা তা লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : তখন আপনারা কীভাবে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : আসলে লিভার সিরোসিস হওয়ার আগে আমরা যদি রোগগুলো কোনোভাবে ধরতে পারি তাহলে এর চিকিৎসা করা যায়। আর এর ওষুধগুলোও সস্তা এবং সহজলভ্য। হেপাটাইটিস বি-এর ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার ওষুধে কাজ হয়। আর ইনজেকশন রয়েছে, তবে একটু দামি, সেগুলোতেও কাজ হয়। হেপাটাইটিস সি এর ক্ষেত্রে ইনজেকশন এত দিন ছিল। খুব সম্প্রতি মুখে খাওয়ার ওষুধও এসেছে। তবে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া এ ধরনের চিকিৎসা না নেওয়াই ভালো।
আপনার মাধ্যমে আমি একটি তথ্য সবাইকে বলতে চাচ্ছি হেপাটাইটিস বি হলেই ওষুধ লাগবে তা নয়। এখানে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। ভাইরাসটা কতটুকু শক্তিশালী সেটাকে আমাকে জানতে হবে। পাশাপাশি ওই রোগীর ক্ষেত্রে দেখতে হবে কতটুকু ক্ষতি হয়ে গেছে। লিভারের আল্ট্রাসোনোগ্রাম করলে আমরা এটা বুঝতে পারব। আর হেপাটাইটিস সি-এর ক্ষেত্রে যেই পরীক্ষা করতে হয় সেটা হলো হেপাটাইটিস সি আর এন। পাশাপাশি জেনোটাইপিং। অতএব এসব পরীক্ষা না করে কেউ যেন ওষুধ না দেয় বা না নেয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কোনো রোগীর ভাইরাসটি অকার্যকর পর্যায় থাকলে সেটা তেমন ক্ষতিকর না।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, তখন যদি আপনারা এই জাতীয় আশস্তমূলক কথা বলেন তখন অনেক কাজে দেয়...
উত্তর : হ্যাঁ, আমরা তাদের বলি এটা অকার্যকর ভাইরাস। দেহে তেমন কোনো ক্ষতিই করবে না। আমরা রোগীকে এই বিষয়ে নিশ্চিত করি এবং এর ভ্যাকসিন নিতে বলি। তবে হেপাটাইটিস সি-এর ক্ষেত্রে কোনো ভ্যাকসিন নেই। সেই ক্ষেত্রে সি খুব মারাত্মক। ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ সিরোসিস হবেই যদি চিকিৎসা না করা হয়।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বি এবং সি-এর প্রকোপ কতখানি আপনারা দেখছেন?
উত্তর : আমরা বিভিন্ন গবেষণা করে দেখেছি। সাধারণ মানুষ, বিদশেগামী কর্মীদের মধ্যে দেখেছি, গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে দেখেছি। আমার নিজস্ব কিছু গবেষণা রয়েছে এ বিষয়ে। গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে হেপাটাইটিসের হার চার থেকে পাঁচ শতাংশ। তবে হেপাটাইটিস সি এ দেশে অনেক কম, শতকরা এক ভাগেরও কম।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?
উত্তর : শুরুতে যেটা বলেছিলাম যে মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে ছড়ায় সেগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। রক্ত নেওয়ার আগে স্ক্রিনিং টেস্ট করেন। স্যালুনে না গিয়ে নিজস্ব রেজার ব্যবহার করুন। রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হোন। সার্জারি করতে গেলে যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।