নীরব ঘাতকের নাম উচ্চ রক্তচাপ
বর্তমানের একটি প্রচলিত স্বাস্থ্য সমস্যা উচ্চ রক্তচাপ। একে নীরব ঘাতকও বলা হয়। আজ ২৫ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১০০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী।
urgentPhoto
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের অর্থ কী?
উত্তর : উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপ থাকার পরেও রোগী তার শরীরে এর কোনো লক্ষণ দেখেন না। যদি রক্তচাপ মাপতে গিয়ে সিস্টোলিক ১৪০ মিলিমিটার মার্কারি আর ডায়াস্টোলিক ৯০ মিলিমিটার মার্কারির ওপরে থাকে, তখন উচ্চ রক্তচাপ বলে।
সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ হলে কিছু কিছু লক্ষণ থাকতে পারে। মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যখা, মাথা ঘোরানো, বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট -এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে সমস্যা থাকবে সেটা ঠিক নয়। অনেক সময় দেখা যায়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়েই রোগীরা আসে।
প্রশ্ন : তাহলে কী কী ধরনের জটিলতা হতে পারে সেটি একটু বলুন?
উত্তর : হার্টে কিছু কিছু জটিলতা হয়। উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবে হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। হার্টের মাংসপেশিগুলো বড় হয়ে যায়। হার্ট বড় হয়ে যায়। এ ছাড়া হার্টের রক্তনালিতে ব্লকজনিত সমস্যা, যেটাকে আমরা বলি করোনারি আর্টারি ডিজিস- সেটি হয়। মস্তিষ্কে কিছু কিছু সমস্যা হয়। যেমন হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। আবার স্ট্রোক, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ইসকিমিক স্ট্রোক ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের কারণে হয়। এ ছাড়া কিডনিতে সমস্যা হয়। যেমন কিডনি ফেইলিউর হচ্ছে বা প্রস্রাব হচ্ছে না- এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। চোখেও সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া পায়ে গ্যাংরিন ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : আমরা জানি উচ্চ রক্তচাপ আসলে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এই নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আপনারা কী কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : যদি আমরা প্রথমে বলি উচ্চ রক্তচাপ হলে আর সারবে না তখন রোগীরা হতাশ হয়ে যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ ঠিক হয়ে যায়। যেমন, চিন্তার কারণে বা গর্ভাবস্থায় যদি উচ্চ রক্তচাপ হয়, হঠাৎ করে ঘুম হচ্ছে না– এ ধরনের কারণে যদি উচ্চ রক্তচাপ হয়, সেটা কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যায়।
আবার কিছু কিছু রক্তচাপ নির্দিষ্ট কিছু কারণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। যেমন : জন্মগত রক্তনালি সমস্যা, হঠাৎ করে কিডনির সমস্যা হলো তার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ রইল- এই ধরনের কিছু কিছু চিকিৎসাযোগ্য উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সেই রক্তচাপ পরিপূর্ণ ভালো হয়ে যাবে।
আর বেশির ভাগ সময়ই সাধারণত ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে রক্তচাপ থেকে যায়। তাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা লাগে। একে আমরা বলি এসেনশিয়াল হাইপার টেনশন। এই রক্তচাপগুলোর কারণ সাধারণত খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কিছু কিছু জিনিসকে এর জন্য দায়ী বলা হয়। যেমন : বেশি পরিমাণ লবণ খাওয়া, কোলেস্টেরল-জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, ওজন বেশি থাকা, ধূমপান বেশি করা, অ্যালকোহল সেবন করা। এ ছাড়া এন্ডোক্রাইন রোগের সঙ্গেও এর সম্পর্ক থাকে। যেমন থাইরয়েডের যদি সমস্যা হয়। কিডনির সমস্যার কারণে উচ্চ রক্তচাপ থাকবে। কারণটা যদি বের করা যায় তবে চিকিৎসা করা সহজ হয়। আর যে ক্ষেত্রে কারণটি সুনির্দিষ্ট নেই, সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু জিনিস রয়েছে।
যেমন লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন অর্থাৎ জীবনধারণের পরিবর্তন।
এর মধ্যে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো, ধূমপান বেশি করলে বন্ধ করার জন্য বলা হয়। অ্যালকোহল বেশি খেলে সেটা বন্ধ করার জন্য বলা হয়। চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে বলা হয়। লবণ কম খেতে বলা হয়। শাকসবজি ও ফল বেশি খাওয়ার জন্য বলা হয়। ফল এবং শাকসবজি উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে রাখে, ওজন কমিয়ে রাখে।
এ ছাড়া হাঁটতে পরামর্শ দিই। দৈনিক ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটলে ভালো হয়।
এরপরও যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তখন ওষুধের প্রয়োজন হয়। তবে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করা ভালো।
প্রশ্ন : ওষুধ খাওয়ার যে ভীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকে, সেটা কীভাবে দূর করেন?
উত্তর : আসলে যদি এসেনশিয়াল হাইপার টেনশন হয়, যে হাইপার টেনশনের বেলায় কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া না যায়। আর যদি চাপ বেশি থাকে, তাহলে ওষুধ দেওয়া হয়। তবে প্রাথমিকভাবে ওষুধ খেয়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের আর প্রয়োজন হয় না। আর এরপরও যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আসে সে ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হবে।
অন্যান্য রোগের ওপর বিবেচনা করে ডাক্তার ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। এবং উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সাধারণত নিয়মিত খাওয়া উচিত। ওষুধ বন্ধ করলে হঠাৎ করে ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাওয়ার জন্য সমস্যা হতে পারে। স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে। তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নিয়মিত ওষুধ খাবেন। মাঝে মাঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। ওষুধের ডোজ বাড়ানো বা কমানো ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করবেন।
আর মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন এর ফলে হার্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না কিডনির সমস্যা হচ্ছে কি না।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকির মধ্যে কারা পড়ে?
উত্তর : যাঁদের বয়স চল্লিশের ওপরে থাকে, তাঁরা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে, মেনোপজের পরে। মুখে খাওয়ার জন্মনিয়ন্ত্রক পিল নিয়ে থাকেন। কিছু কিছু ওষুধ যাঁরা খান যেমন ব্যথানাশক ওষুধ, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ খান। যাঁদের ওজন বেশি থাকে, যাঁদের ডায়াবেটিস থাকে, কায়িক পরিশ্রম কম করেন, এসব লোকের এই সমস্যার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। যাঁরা লবণ বেশি খান। এ ছাড়া পরিবারের কারো যদি উচ্চ রক্তচাপের রেকর্ড থাকে। তাহলে আরেকজনের হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
প্রশ্ন : একটা সময় আমরা দেখতাম শুধু প্রবীণদের মাঝে এই সমস্যা থাকত। এখন দেখা যায়, তরুণদের মাঝেও এর প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে।
উত্তর : ৩০ বছরের পর যদি কারো এই সমস্যা থাকে, তবে সেকেন্ডারি কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যেমন কিডনির কোনো সমস্যা আছে কি না, জন্মগত হার্টের কোনো সমস্যা আছে কি না, হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপার থাইরয়েডিজম যদি থাকে সেটা দেখতে হবে। যদি আমরা খুঁজে না পাই, সেকেন্ডারি লাইফস্টাইল দায়ী কি না সেটা দেখতে হবে। কর্মস্থলে চাপ থাকে, একটা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকে-এসব বিভিন্ন কারণে মানুষের চাপ অনেক বেশি। এই চাপ কমানো প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রিত জীবনপ্রণালির মধ্যে থাকতে হবে।