থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কী
রক্তের একটি জটিল রোগ থ্যালাসেমিয়া। এটি জন্মগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এই রোগে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থেকে চিকিৎসা করতে হবে। আজ ৫ আগস্ট, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১১১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা ব্লাড ক্যানসার ও রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা এ বি এম ইউনূস।
প্রশ্ন : থ্যালাসেমিয়া নামটি অনেকেই এখন জানে। অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ হয় কেন এবং এর কারণ কী?
উত্তর : থ্যালাসেমিয়া কোনো পরিবেশ দ্বারা বা জীবাণু দ্বারা হয়, বিষয়টি তা নয়। এটি একটি বংশগত রোগ। এটি জন্মগত বা বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। একটি শিশুর দৈহিক গঠন থেকে শুরু করে সবকিছু জিনগতভাবে নিয়ন্ত্রিত। তার বাবা-মায়ের গুণাবলি তার ভেতরে সঞ্চারিত হয়। ঠিক একইভাবে তার ভেতরে যে রক্ত সঞ্চারিত হয়, সেটাও নির্ভর করে তার বাবা ও মায়ের রক্তের গঠন কেমন হবে, তার ওপর। বিশেষ করে রক্তের যে হিমোগ্লোবিন, সেটা পরিবর্তন হয় আলফা ও বেটা দুটো চেইনের মাধ্যমে। এই চেইনের মধ্যে যদি জন্মগত ত্রুটি বাবা-মায়ের মধ্যে থাকে, চেইন যদি দুর্বল হয়, যে পরিমাণ চেইন তৈরি হওয়ার কথা সে পরিমাণ না থাকে, জিনগত কোনো সমস্যার কারণে এ সমস্যা হতে পারে। এটা বাবা-মায়ের মধ্যে থাকলে সন্তানের ভেতর সঞ্চারিত হয়। তাহলে একজন বাবা ও মা তাঁর ভেতরে যদি থ্যালাসেমিয়ার কোনো জিন (অর্থাৎ হিমোগ্লোবিন তৈরির যে সমস্যা সেটা যদি থাকে, তাহলে বাচ্চার ভেতর এটা সঞ্চারিত হবে) থাকে, বাচ্চা তখন এই রোগের বাহক বা এই রোগে আক্রান্ত হবে। যদি বাবা ও মায়ের মধ্যে শুধু একজনের কাছ থেকে এসে থাকে, একে বলব থ্যালাসেমিয়া মাইনর। আর যদি উভয়ের কাছ থেকে এসে থাকে, তখন জটিল আকার ধারণ করতে পারে। অথবা মাঝামাঝি অবস্থান ধারণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা একে বলব থ্যালাসেমিয়া মেজর।
প্রশ্ন : এই মাইনর ও মেজরের বিষয়টি কী? অনেক সময় রক্তে জিনগত কারণে সমস্যা বা বেটাচেইনের সমস্যা হলেও রোগটি প্রকাশ পাচ্ছে না। আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে। এর কারণগুলো কী?
উত্তর : বিষয়টি হলো বাবা ও মা উভয়ের ক্ষেত্রে যদি কোনো জেনেটিক সমস্যা থাকে এবং উভয়ের কাছ থেকে যদি থ্যালাসেমিয়ার জিন নিয়ে আসে, বংশপরম্পরায় যদি তার মধ্যে ধারণ করে নিয়ে আসে, তাহলে দেখা যাবে তার হিমোগ্লোবিন তৈরির বিষয়টি একেবারে সংকুচিত হয়ে আসছে। সে ক্ষেত্রে তার জন্মের পর থেকেই বিষয়গুলো শুরু হয় এবং রক্তশূন্যতা হয়। আবার যদি বাবা ও মায়ের মধ্য থেকে যেকোনো একজন থেকে একটা সমস্যাগ্রস্ত জিন যদি বাচ্চার ভেতর সঞ্চালিত হয়, তাহলে (এখানে মনে রাখতে হবে বাবার থেকে একটা জিন এবং মায়ের থেকে একটা জিন, এই এক জোড়া জিন দিয়ে সন্তান তৈরি হয়।) এর মধ্যে একটা জিন যদি সমস্যাগ্রস্ত হয় মা অথবা বাবার কাছ থেকে, তাহলে তার আরেকটি জিন কিন্তু ভালো আছে, ওই সক্রিয় জিন দিয়ে মোটামুটি সে চলনসই হয়ে যায়। মধ্য বয়স পর্যন্ত তার কোনো সমস্যা হয় না। এদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, মধ্য বয়সে গিয়ে রক্তের স্বল্পতা দেখা দেয়।
প্রশ্ন : কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে, বাচ্চাদের থ্যালাসেমিয়া আছে কি না?
উত্তর : যার এই থ্যালাসেমিয়া মেজর, অর্থাৎ যে বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকে তার এই সমস্যাগ্রস্ত জিন জন্মগতভাবে পেয়েছে, তার জন্মের পরপরই দেখা যাবে সে ফ্যাকাসে। আর বাচ্চার যে স্বাভাবিক বৃদ্ধিগুলো হয়, সেগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছে। অর্থাৎ তার হাঁটা, দাঁড়ানোর সময়, বসার সব মাইলস্টোনই ধীরগতির হয়ে যায়। অন্য একটা সাধারণ বাচ্চার সঙ্গে যদি তুলনা করি, তার বৃদ্ধিটা ধীরে হয়। একটা ১০ বছরের স্বাভাবিক বাচ্চার যেমন বাড়ন্ত হবে আর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চাকে দেখতে মনে হবে পাঁচ বছর। এই ফ্যাকাসে মানে হলো তার রক্তস্বল্পতা। তার শক্তি পাচ্ছে না, তার ক্ষুধামন্দা, কোনো কিছুতে সে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই সঙ্গে শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাব। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে বিদেশিদের মতো সাদা। এ ছাড়া তার দুই চোখের দূরত্বটা বেড়ে যায়। নাকের গোড়া প্রসারিত হয়ে যায়। বড় হলে দেখা যাবে দাঁত হয়তো ফাঁক হয়ে আছে। কপালের সামনে যে হাড় আছে, সেটা ফুলে যায়। সবকিছু মিলে তাকে বলা হয় থ্যালাসেমিক ফেসি। অর্থাৎ একটা আদিবাসী ভাব তার মধ্যে দেখা যায়। চোখ অনেকটা হলুদ। হাতের দিকে তাকালেও মনে হবে হলুদ। এর পর যদি তার পেটের দিকে তাকাই দেখা যাবে পেটটা বেশ ফুলে আছে।
আমরা যদি পরীক্ষা করি দেখা যাবে তার প্লিহা। এটা বাঁ দিকে খাঁচার নিচে থাকে। এই প্লিহা প্রথমে বড় হয়, এর পর লিভার আস্তে আস্তে বড় হয়। এই অঙ্গগুলো যখন বড় হয়ে যায়, তখন তার খুব ঘন ঘন রক্ত দিতে হয়। এই রক্ত না দিলে সে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। এই লক্ষণগুলো দেখলে বাবা-মা বুঝবেন তার স্বাভাবিক গতি বৃদ্ধি করছে না।
প্রশ্ন : থ্যালাসেমিয়া রোগের কি কোনো চিকিৎসা আছে, সেটা কি নিরাময়যোগ্য?
উত্তর : থ্যালাসেমিয়া নিরাময়যোগ্য। তবে যেহেতু এটি একটি জন্মগত সমস্যা, যদি তার জিনগত সমস্যাকে পরিবর্তন করা না হয়, অর্থাৎ যে অঙ্গ দিয়ে সমস্যাযুক্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি হচ্ছে, সে অঙ্গ মানে বোনমেরু (অস্থিমজ্জা), এটাকে যদি অস্থিমজ্জা সংযোজনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়, তাহলে একে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে একজন ম্যাচ ডোনার লাগবে। এবং এটা দেশের বাইরে গিয়ে করতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে এটা এখনো চালু হয়নি। আর যাঁরা বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারছেন না, তাঁদের নিয়মিত রক্ত দিয়ে জীবন সচল রাখতে হবে। তবে এই রক্ত দিতে দিতে তাঁর শরীরে সমস্যা তৈরি হয়, আয়রন জমে যেতে পারে। এই আয়রন জমে গিয়ে হার্টের সমস্যা, হরমোনের সমস্যা, লিভার, কিডনি, মস্তিষ্কের সমস্যা এ ধরনের অনেক সমস্যা হয়। তাই একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থেকে রক্ত দিতে হবে এবং জটিলতাগুলোরও চিকিৎসা করতে হবে।