তামাক থেকে হেডনেক ক্যানসার?
এ দেশে ক্যানসার রোগীদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ লোক হেডনেক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করালে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আজ ১৯ আগস্ট, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১২৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াররফ হোসেন।
প্রশ্ন : মানুষের শরীরে যত রকম ক্যানসার হয়, তার মধ্যে পুরুষ ও নারীর মিলিয়ে শতকরা ২৫ ভাগের ওপর লোকের হেডনেক ক্যানসার ধরা হয়, অর্থাৎ এত বেশিসংখ্যক মানুষ এই ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আপনি বলবেন কি, হেডনেক ক্যানসার বলতে আমরা শরীরের কোন অংশের ক্যানসারকে বুঝিয়ে থাকি? এবং এই ক্যানসার এত ব্যাপক মাত্রায় হওয়ার কারণ কী?
উত্তর : আমেরিকা অথবা ইউরোপের কোনো দেশে আপনি যদি ১০০ রোগী জড়ো করেন, তাহলে তিন থাকে পাঁচজনের বেশি এই ক্যানসার পাবেন না। আবার বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তান—এই তিনটি জায়গায় যদি কোনো ক্যানসার সেন্টারে যান, এর মধ্যে ১০০ জন ক্যানসারের রোগীকে একপাশে জড়ো করে দেখেন এবং গুনতে থাকেন। দেখবেন, অন্তত ২৫ জনের হেডনেক ক্যানসার রয়েছে বা মুখগহ্বর, জিহ্বা, গলনালি, শ্বাসনালির ক্যানসার রয়েছে। আমেরিকা-ইউরোপের সঙ্গে আমাদের দেশে পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি রোগী।urgentPhoto
প্রশ্ন : এত বেশি হওয়ার কারণ কী?
উত্তর : কারণ, আমেরিকার লোকে তো পান খায় না। তারা জর্দা ব্যবহার করে না। সাদাপাতা খাচ্ছে না। গুলও ব্যবহার করছে না। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ তামাক ব্যবহার করছে। সেটাকে যে নামেই ডাকেন না কেন—জর্দা, সাদাপাতা, গুল, খৈনি—এসব ব্যবহারে আমাদের দেশের মানুষ অভ্যস্ত। আপনি খুব ভালো করে লক্ষ করে দেখবেন, আমরা যাঁরা গ্রামের ছেলে, আমরা দেখলাম, কোনো মেহমান যদি বাসায় আসে একখিলি পান দিয়ে তাঁকে প্রথমে আপ্যায়ন করা হয়। দেখা গেল, তাঁকে শুধু আপ্যায়ন না, বিরাট ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন। রোগ তো আজ হবে না। কিন্তু দেখা গেল পাঁচ বছর, সাত বছর, ১০ বছর পরে এ ধরনের গলনালি, শ্বাসনালি, মুখগহ্বর বা জিহ্বার ক্যানসারে ভুগতে পারে।
এমন বিষয় আসলে ভয়াবহ ক্যানসার রোগকে আমন্ত্রণ জানানোর শামিল। আমি মনে করি, কোনো মেহমান গেলে অন্তত তাঁকে এক গ্লাস পানি দিতে পারেন। আরেকটু ভালো হয়, আমাদের গ্রামে অনেক ডাবগাছ আছে, ডাবের পানি দিতে পারেন। শরবত দিতে পারেন। অন্তত মানুষটি ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রশ্ন : আমরা জানি, ধূমপান করলে ফুসফুসের ক্যানসার হয়। এগুলো নিয়ে অনেক প্রচার আছে। তবে যেগুলো চিবিয়ে খাওয়ার তামাকজাত দ্রব্য, সেগুলো নিয়ে তেমন কোনো প্রচার নেই। আসলে ক্যানসার সৃষ্টিতে এই দুটোর কি কোনো তারতম্য আছে?
উত্তর : আমরা বলি, স্মোকড টোব্যাকো আর নন-স্মোকড টোব্যাকো। দুটো আসলে একটাই, সেটা হলো তামাক। কোনোটা হয়তো আমরা ধোঁয়ার আকারে ব্যবহার করি, কোনোটা চিবিয়ে খেয়ে ব্যবহার করি। কিন্তু ফলাফল একই। ধোঁয়াযুক্ত যে বিড়ি-সিগারেট খাই, সেটা ফুসফুসের ক্যানসার তৈরি করে। আপনি যদি ১০০ জন ফুসফুসের ক্যানসার রোগীর সাক্ষাৎকার নেন, দেখবেন তাঁদের মধ্যে ৮৫ জন জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে এবং প্রতিদিন অনেক বেশি পরিমাণে এই ধরনের বিড়ি-সিগারেট দ্বারা অভ্যস্ত ছিলেন। আবার হেডনেক ক্যানসারের ক্ষেত্রে কিছুটা তো স্মোকড টোব্যাকোর প্রভাব আছেই। এ ছাড়া চিবিয়ে খাওয়ার যেসব তামাক, এটার প্রভাব আরো বেশি। তবে আমরা খুব সৌভাগ্যবান, আমাদের দেশের মানুষ বেশি মদ খায় না। কিন্তু বিদেশের মানুষ মদ খায়। যদি আমাদের দেশে লোকেরা তামাকের সঙ্গে মদটা ব্যবহার করত, তাহলে ঝুঁকি আরো বেড়ে যেত। আমাদের দেশের লোক অবশ্য মদ ওভাবে খায় না।
প্রশ্ন : একজন মানুষ হেডনেক ক্যানসারে আক্রান্ত হলে তাঁর প্রাথমিক লক্ষণ কী দেখা দিতে পারে? কী ধরনের সমস্যা দেখলে তাঁর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : আমি বলব, ক্যানসার হলে যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের কাছে আসা যায়, তত ভালো। হেডনেক ক্যানসারের সুবিধা হলো, মানুষ ইচ্ছা করলে আগে আসতে পারেন। আপনি দেখবেন, জিহ্বার মধ্যে একটা ঘা হচ্ছে। অনেক দিন ধরে আছে, সেটা শুকাচ্ছে না। মলম লাগাচ্ছেন, তবুও ভালো হচ্ছে না। তখনই তাঁর মাথায় প্রশ্ন আসা উচিত। অনেক দিন ধরেই তো ঘা শুকাচ্ছে না, আসলে কি এটা ক্যানসার? সে জন্য বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : অনেক দিন বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন? যদি দেখা যায়, ওষুধ খাচ্ছেন তবুও কমছে না, তাহলে আসলে কত দিন এ রকম থাকলে বোঝা যাবে?
উত্তর : আমি মনে করি, তিন সপ্তাহের বেশি যখন হয়ে যায়, তখনই তাঁকে সচেতন হওয়া উচিত। যেহেতু এটা খুব স্পষ্ট করে দেখা যায়, রোগী নিজেও একটা আয়নার সামনে নিয়ে দেখতে পারে। হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সেটা আরো বাড়ছে বা কমছে কি না, সে নিজেই বলতে পারবে। এ ছাড়া আমরা যেটাকে বলি স্বরযন্ত্র বা ভোকাল কর্ড, যখনই এখানে রোগীর ক্যানসার হলো, আপনি দেখবেন যে তাঁর গলা ভেঙে গেছে। অনেকেই হয়তো জিজ্ঞেস করছে, আপনার গলা ভাঙা কেন? উনি হয়তো বলেন, গতকাল খুব চিৎকার করে ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ হয়তো বলেন, খুব জোরে কথা বলেছি। আসলে তাঁকে দেখতে হবে, এই গলা ভাঙা কত দিন ধরে তাঁর যাচ্ছে না। গরম পানি খাচ্ছেন, অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন, অনেক কিছুই করছেন; কিন্তু তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরেও ভালো হচ্ছে না। আমি মনে করি, তখনই তাঁর সচেতন হওয়া উচিত। তখন যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নেন, তবে একটা মাত্র পরীক্ষা করেই দেখা যাবে তাঁর গলায় ক্যানসার হয়েছে কি না।
প্রশ্ন : একজন মানুষ যদি এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে এটা কি চিকিৎসা করলে নিরাময়যোগ্য?
উত্তর : আমরা যদি বলি, প্রাথমিক অবস্থায় সে আসে, এটা অবশ্যই নিরাময়যোগ্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক অবস্থায় আসে না। অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র হওয়ার কারণে প্রথম বড় চিকিৎসা বা বড় খরচের দিকে যায় না। মানুষ প্রথমে চিন্তা করে, একটু কবিরাজি, একটু হোমিওপ্যাথি বা পানি পড়া খেয়ে যদি একটু ভালো থাকা যায়। এই করতে করতে দেখা যায়, রোগটা আস্তে আস্তে বেড়ে যায়। ক্যানসার বেড়ে গেলে এবং শারীরিক দুর্বলতা সব মিলিয়ে সে চিকিৎসার অযোগ্য হয়ে পড়ে। এবং রোগটি শরীরের অন্যান্য জায়গাও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রশ্ন : একজন মানুষ যদি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন, তবে কী ধরনের চিকিৎসা করা যেতে পারে?
উত্তর : প্রথমে হেডনেক সার্জারি করা যেতে পারে। আজকাল রেডিয়েশনের বেশ ভালো ব্যবস্থা আছে, বিশেষ করে যে আধুনিক রেডিওথেরাপি রয়েছে, থ্রিডি, আইএমআর—সেগুলো খুব কার্যকর। এ ছাড়া যদি রোগটি কাছাকাছি কোথাও ছড়িয়ে পড়ে, তবে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দেওয়া যায়। এগুলো দিয়ে আমরা রোগীকে অনেক ভালো অবস্থায় রাখতে পারি।
প্রশ্ন : ক্যানসারের চিকিৎসায় আপনারা খুব পরিচিত একটি শব্দ ব্যবহার করেন, ফাইভ ইয়ার সারভাইভাল রেট বা পাঁচ বছরে বেঁচে থাকার বয়স। এর মানে কী? এই রোগ ভালো হওয়ার পরিমাণ কত এ দেশে?
উত্তর : আমরা কাউকে বলতে পারি না, আপনি ঠিক এত দিনই বেঁচে থাকবেন। আমরা বলি, যাঁরা এক বা দুই পর্যায়ের ক্যানসার নিয়ে আসবেন, তাঁদের মধ্যে ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৮০ জনের পাঁচ বছরের বেশি সময় ভালো থাকার সম্ভাবনা অনেক। তবে সেটা পাঁচ বছরের নিচে নয়। সেটা পাঁচ, ১০, ১৫ বা ২০ বছরও হতে পারে।
আর যাঁরা রোগ বেড়ে যাওয়ার পর আসেন, পর্যায় তিন, চার; তাঁদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার সংখ্যাটা অনেক কম। বিশেষ করে পর্যায় তিনে আমরা বলি ৪০ শতাংশ। পর্যায় চারে আমরা বলি ১০ শতাংশের নিচে। সুতরাং প্রাথমিক অবস্থায় আসতে হবে। যত আগে আসবে, ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক।