বিখ্যাত সেই ‘ছাইভস্ম’র ইতিকথা
বিশ্বায়নের যুগে ক্রিকেট খেলাটা প্রায় সব মহাদেশে ছড়িয়ে গেলেও একটা সময় খেলাটি কেবল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮৭৭ সালে প্রথম টেস্টটি খেলে এই দুটি দেশ। প্রথম টেস্ট ম্যাচটি অস্ট্রেলিয়া জিতলেও পরের টেস্টে জয়ের খাতা খোলে ইংল্যান্ডও। দুদলের মধ্যে খেলা পরের চারটি সিরিজের তিনটিতেই জেতে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৮২ সালে দুদলের মধ্যে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় এক টেস্টের সিরিজ।
এর আগে অস্ট্রেলিয়া দল একবারই এসেছিল ইংল্যান্ডে। সেবার সিরিজটা জিতে নেয় স্বাগতিকরা। ১৯৮২ সালে সেই টেস্টে ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। দুদলে চার্লস ব্যানারম্যান, ডব্লিউ জি গ্রেস, বিলি বার্নসের মতো কিংবদন্তিরা ছিলেন।
দুই বাঁ-হাতি পেসার ডিক বার্লো ও ফ্রেড মরলির বোলিং তোপে পড়ে মাত্র ৬৩ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ১০১ রানে শেষ হয় ইংল্যান্ডের ইনিংস। ক্রিকেটের প্রথম হ্যাটট্রিকম্যান ফ্রেডরিক স্পোফোর্থ নেন ৭ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করে ১২২ রান। ফলে ইংল্যান্ডের সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৮৪ রান। এই ছোট লক্ষ্য তাড়া করেও জিততে পারেনি ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসেও স্পোফোর্থ নেন ৭ উইকেট। ইংল্যান্ড গুটিয়ে যায় ৭৭ রানে।
লজ্জার হারের পর ইংল্যান্ডজুড়ে শুরু হয় সমালোচনা। পরাজয়টা দারুণভাবে আঘাত করে অহংকারী ইংলিশদের। কারণ অস্ট্রেলিয়া তখন ইংল্যান্ডের একটি উপনিবেশ। অসিদের শাসন করেন ইংল্যান্ডের রানি। আর সেই অস্ট্রেলিয়ার কাছেই কিনা হেরে গেল ইংল্যান্ড!
স্থানীয় একটি পত্রিকা ‘দ্য স্পোর্টিং টাইমস’ পরাজয়ে আহত ইংল্যান্ডবাসীর ক্ষতে নুন ছিটিয়ে দিল। পত্রিকাটি তাদের শিরোনামে লিখল, ‘মর্মাহত হৃদয়ে বন্ধু ও সহমর্মীদের জানানো হচ্ছে, ১৮৮২ সালের ২৯ আগস্ট ওভালে ইংলিশ ক্রিকেটের মৃত্যু হয়েছে। শান্তিতে ঘুমাক ইংলিশ ক্রিকেট। মৃত ক্রিকেটের দেহ ভস্মীভূত করা হয়েছে এবং ছাইগুলো অস্ট্রেলিয়াকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
হারের বেদনায় গোটা ইংল্যান্ড তখন শোকের মাতম গাইছে। পরের বছর ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়। এই সফরের আগে দেশজুড়ে রব উঠে যায়। আগের টেস্ট হারের বদলা চায় দেশবাসী এমন জাতীয়তাবাদী সুর বাজতে থাকে ইংল্যান্ডে। আগের টেস্টের অধিনায়ক মাঙ্কি হর্নবিকে ততদিনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইভো ব্লিংকে দেওয়া হয় হারের বদলা নেওয়ার দায়িত্ব।

হারের বদলা নেওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইভোর ব্লিংয়ের দল তখন অস্ট্রেলিয়ায়। প্রথম টেস্টে ৯ উইকেটে হেরে যায় ইংল্যান্ড। হারের বদলা তাহলে নেওয়া হবে না? গল্প-উপন্যাসকেও হার মানাল ইংল্যান্ডের সিরিজ জেতার কাহিনী। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড তোলে ২৯৪ রান। জবাবে বিলি বেটসের ঘূর্ণিতে ১১৪ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। ফলো অনে পড়া অস্ট্রেলিয়া দল অলআউট হয় ১৫৩ রানে। এই ইনিংসেও বেটস নেন ৭ উইকেট। শেষে টেস্টে ডিক বার্লো ও ফ্রেড মরলির আগুনঝরা বোলিংয়ে ইংল্যান্ড জেতে ৬৯ রানে।
ইংল্যান্ডজুড়ে নায়ক বনে যান ইভো ব্লিং। শোনা যায়, ১৯৮২ সালে টেস্ট হারের শোক সইতে না পেরে সেই ম্যাচের একটি স্টাম্প পুড়িয়ে ফেলেন এক নারী। পরের বছর ইভো ব্লিংয়ের দল সিরিজ পুনরুদ্ধার করলে মেলবোর্নে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাশেজ জয়ের স্মারক হিসেবে সেই স্টাম্পের ছাই ইংল্যান্ড দলকে উপহার দেন দেশটির একদল নারী। এর পর থেকেই সেই ছাইভস্ম পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে মাঠে নামে দুই দেশ। শুরু হয় ক্রিকেটের সবচেয়ে উপভোগ্য লড়াই অ্যাশেজ সিরিজ।

ফাহমিদ সৌরভ