টেলিভিশনের দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন ট্রাম্প
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে যখন ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া চলছিল, ট্রাম্প নাকি তখন রাগান্বিত ভঙ্গিতে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে এবিসি নিউজ এ খবর জানিয়েছে।
এবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিশংসন প্রক্রিয়া চলাকালে টেলিভিশনের পর্দায় ট্রাম্প যখন দেখেন যে, তাঁর দল রিপাবলিকানেরই কয়েকজন সদস্য মার্কিন কংগ্রেস ভবনে সহিংসতার ঘটনায় তাঁকে দায়ী করছেন, তখন ট্রাম্প ক্রমেই রাগান্বিত হতে থাকেন।
এদিকে, অভিশংসিত হওয়ার পরই ভিডিওবার্তার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। তবে ওই বিবৃতিতে অভিশংসন নিয়ে কোনো কথাই বলেননি তিনি। ওই বার্তায় তিনি তাঁর সমর্থকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমার সত্যিকারের কোনো সমর্থক রাজনৈতিক সহিংসতা করতে পারে না। আমার সত্যিকারের কোনো সমর্থক কখনো আইনকে বা আমাদের পতাকাকে অসম্মান করতে পারে না।’
ট্রাম্প সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যারা আমাদের নীতিতে বিশ্বাসী, তাদের উত্তেজনা পরিহার, শান্ত থাকা ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রচারে সহায়তার উপায় সম্পর্কে ভাবার আহ্বান জানাচ্ছি।’
মার্কিন কংগ্রেস ভবনে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে স্থানীয় সময় বুধবার অভিশংসিত হন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হলেন। হাউসে ২৩২-১৯৭ ভোটে অভিশংসন প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর মধ্যে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানের ১০ জন রয়েছেন, যাঁরা ট্রাম্পকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ওই ১০ রিপাবলিকান সদস্য হলেন নিউইয়র্কের জন কাটকো, ইলিনয়ের অ্যাডাম কিনজিনগার, ওয়াশিংটনের জেমি হেরেরা, ওয়াশিংটনের ড্যান নিউহাউজ, ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিড ভ্যালেদাও, মিশিগানের পিটার মেইজার, সাউথ ক্যারোলাইনার টম রাইস, মিশিগানের ফ্রেড আপটন, ওহাইওর অ্যান্থনি গঞ্জালেজ ও ওয়াইওমিংয়ের লিজ চেনি।
কেন এই ১০ জন রিপাবলিকান ট্রাম্পের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেটি বিভিন্নভাবে খোলাসা করেছেন তাঁরা। সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে ওই ১০ রিপাবলিকানের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে ট্রাম্পকে অভিশংসনের পক্ষে নিউইয়র্কের জন কাটকো বলেছেন, ‘এই সহিংসতাকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উসকে দেওয়া আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি। এজন্য আমি কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বসে থাকতে পারি না।’
ইলিনয়ের অ্যাডাম কিনজিনজার মনে করেন, নেতাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এটি (অভিশংসন) মার্কিন জনগণের জন্য একটি জাগরণ।
ওয়াশিংটনের জেমি হেরেরা বলেছেন, ‘আমার সংবিধান পড়ার নিরীক্ষায় প্রেসিডেন্টের অপরাধ অভিশংসিত হওয়ার মতো। আমি আমাদের সংবিধান, স্বতন্ত্র স্বাধীনতা, মুক্ত বাজার, চ্যারিটি, জীবন, ন্যায়বিচার, শান্তি এবং এই দেশের প্রতি বিশ্বাস রাখি। আমি দেখেছি, আমাদের এই দলটি তখনই দেশকে সবার চেয়ে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, যখন আমরা সঠিকটি বেছে নেই। আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর শপথের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।’
কংগ্রেস ভবনে সংঘটিত নৃশংস হামলার দিকে অন্ধভাবে তাকিয়ে থাকা কোনো বিকল্প নয় বলে মনে করেন ওয়াশিংটনের ড্যান নিউহাউস।
ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিড ভ্যালেদাও বলছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিঃসন্দেহে গত ৬ জানুয়ারি সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন।’
মিশিগানের পিটার মেইজার বলেছেন, ‘ট্রাম্প আমাদের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সংকুচিত করার চেষ্টায় তাঁর নেওয়া শপথের বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং গত সপ্তাহে আমরা যে সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছি, সেটিতে উসকানি দেওয়ার দায়ভার তাঁরই।’
সাউথ ক্যারোলাইনার টম রাইস জানান, তিনি ট্রাম্পের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন এবং তাঁকে দুবার ভোট দিয়েছেন। তবে সন্দেহাতীতভাবে তাঁর পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আপত্তি জানানো ১৩৯ জন রিপাবলিকানদের মধ্যে একজন ছিলেন রাইস।
রাইস এক টুইটবার্তায় রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘গত সপ্তাহে যখন ক্যাপিটলে সহিংসতা হলো, তখন প্রেসিডেন্ট কোথায় ছিলেন?’
মিশিগানের ফ্রেড আপটন বলেছেন, ‘কংগ্রেসকে অবশ্যই ট্রাম্পের উদ্দেশে পরিষ্কারভাবে একটি বার্তা পাঠাতে হবে যে, আমাদের দেশ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে সহ্য করবে না।’
ট্রাম্প কংগ্রেস ভবনে হামলাকারীদের সংগঠিত ও উসকে দিতে সহায়তা করেছেন বলে স্পষ্ট অভিমত দিয়েছেন ওয়াইওর অ্যান্থনি গঞ্জালেস।
ওয়াওমিংয়ের লিজ চেনিও মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কোনো সহিংসতা কখনোই ঘটত না।
গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে নজিরবিহীন হামলার ঘটনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মদদ ছিল অভিযোগ করে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে সোমবার অভিশংসন প্রস্তাব আনেন ডেমোক্র্যাটরা। এই অভিশংসনের পক্ষ নেন একাধিক রিপাবলিকান সদস্যও।
এদিকে, ট্রাম্পের বিদায়ের আগে সিনেটে কোনো অধিবেশন বসবে না। ফলে সিনেটে ট্রাম্প অভিশংসিত হলেও তিনি নির্ধারিত সময়েই, অর্থাৎ আগামী ২০ জানুয়ারি বিদায় নেবেন। তবে সিনেটে অভিশংসিত হলে ট্রাম্প আর কখনোই মার্কিন নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না।
ট্রাম্পকে অভিশংসনের ব্যাপারে হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমাদের দেশের বিরুদ্ধে এই সহিংসতাকে, এই সশস্ত্র হামলাকে উসকে দিয়েছিলেন। তাঁর অবশ্যই চলে যাওয়া উচিত। তিনি পরিষ্কারভাবে এবং বর্তমান সময়ে আমাদের রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক, যে রাষ্ট্রকে আমরা ভালোবাসি।’
ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান জুলিয়ান কাস্ত্রো ট্রাম্পকে ভোটের লড়াইয়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক মানুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এর আগে ২০১৯ সালে ট্রাম্পকে অপসারণে নিম্নকক্ষে অভিশংসন প্রস্তাব পাস হয়। তবে উচ্চকক্ষ সিনেটের রায়ে তা বানচাল হয়ে যায়। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, হাউস সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পেলে প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হবেন। কিন্তু, প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউস ছাড়া করতে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
এদিকে, ট্রাম্প এখন সিনেটে দোষী সাব্যস্ত হবেন কি না, সেটিই দেখার বিষয়। ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান না নিলেও তাঁর পদত্যাগ কিংবা অপসারণকে সমর্থন করছেন বেশ কয়েকজন সিনেটর। তবে, সিনেটে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরের ভোট পেতে হবে।
গত ৬ জানুয়ারি জো বাইডেনের বিজয় কংগ্রেসে অনুমোদনের দিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলা চালায় ট্রাম্প সমর্থকেরা। এ ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। সেদিন ৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আরো বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।