তুরস্কে ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ থেকে যেভাবে উদ্ধার হলো ২ বোন
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/02/12/tursk-duibon.jpg)
‘মেরভে! ইরেম! মেরভে! ইরেম!’ নাম ধরে চিৎকার করছিলেন উদ্ধারকর্মী মুস্তাফা ওজতুর্ক। এ সময় চারপাশের লোকজনকে নীরব থাকার নির্দেশ দেওয়া হলো। উদ্ধারকারী দলটি ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পড়া অবস্থায় বেঁচে থাকা দুই বোনকে উদ্ধারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।
স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতির সাহায্যে তারা যেকোনো সাড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় আশায় জমে যাচ্ছিলেন সবাই। সে সময় মুস্তাফা বলে ওঠলেন, ‘ইরেম, আমি আপনার কাছাকাছি, আমাকে আপনি শুনতে পাচ্ছেন, হ্যাঁ?’
যারা দেখছিলেন তারা কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না, তবে মেয়ে দুটির বন্ধুদের একটি দল এ সময় নীরবে উদ্ধারকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
সেই মুহূর্তে মুস্তাফা বলে ওঠলেন, ‘চমৎকার, এখন শান্ত থাকুন, আর আমার কথার উত্তর দিন। ঠিক আছে। সে মেরভে। মেরভে, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে আন্তাকিয়া এলাকায় ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত একটি পাঁচতলা এপার্টমেন্ট ব্লকের ধ্বংসাবশেষের নিচে আটকা পড়েন দুই বোন মেরভে (২৪) ও ইরেম (১৯)। আটকে পড়া অবস্থায় দুদিন পেরিয়ে গেলেও তাদের জন্য সেটা ছিল কয়েক সপ্তাহের মতো।
‘আজ বুধবার। না, আপনারা চৌদ্দ দিন ধরে আটকে ছিলেন না। আমাদের পাঁচ মিনিট সময় দিন। আপনাদের বের করে আনা হবে।’ মুস্তাফা জানতেন এই কাজে কয়েক ঘণ্টা লাগবে, তবে তিনি বললেন, ‘যদি তারা আশা হারিয়ে ফেলেন তবে তারা নাও বাঁচতে পারেন।’
এ সময় মেরভে ও ইরেম কৌতুক বলতে গিয়ে হাসতে লাগল। মুস্তাফার মুখে দেখা গেল লম্বা হাসি। তিনি বললেন, ‘যদি জায়গা পেত তবে দুই বোন নাচতে শুরু করত।’
উদ্ধারকর্মীদের হিসেবে দুই বোন রয়েছে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে দুই মিটার গভীরে। উদ্ধার দলের কমান্ডার হাসান বিনায় জানান, কংক্রিটের নিচ দিয়ে টানেল খুঁড়ে তাদের কাছে পৌঁছানোরে চেষ্টা হবে খুবই জটিল কাজ। এ ক্ষেত্রে একটি ভুল পদক্ষেপ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এ সময় একটি বুলডোজার ডাকা হলো হালকাভাবে কংক্রিট ধরে রেখে খোড়াখুড়ির সময় যাতে এপার্টমেন্টের ভেঙে পড়া অংশগুলো ওপর থেকে না পড়ে।
মুস্তাফা দুই বোনকে বললেন, ‘মেয়েরা, খুব তাড়াতাড়ি আমরা আপনাদের কম্বল দেব। আমাদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা ক্লান্ত বা শীতার্ত নই।’
এরপর উদ্ধারকর্মীরা ক্ষীপ্রতার সঙ্গে জঞ্জাল খুঁড়তে শুরু করে আর খালি হাতেই ময়লা সরিয়ে রাখছিল। তবে, দুই ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীদের পায়ের নিচে মাটি কাঁপতে শুরু করে। এটা ছিল ভূমিকম্পের আফটার শক। এ সময় নিজেদের রক্ষায় উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের কাছ থেকে সরে আসে।
আধাঘণ্টা পর মুস্তাফা ও আরও তিনজন উদ্ধারকর্মী ঘটনাস্থলে ফিরে আসে। এসময় মুস্তাফা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘ভয় পাবেন না। বিশ্বাস করেন আমরা আপনাদের ছেড়ে যাচ্ছি না। আমরা আপনাদের বের করে আনবো ও আপনাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাব।’
এদিকে, মধ্যরাতে আবারও খোঁড়াখুড়ির কাজ শুরু হয়। এ সময় সবাই মাঝে মাঝেই ‘সেসিজলিক’ বা নিরব থাকার জন্য চিৎকার করে উঠছিল। এ সময় চারদিকের আলো নিভিয়ে ফেলা হয় আর কংক্রিটের ভেতর দিয়ে ছোট গর্ত করা হয় যাতে মেয়েরা মুস্তাফার টর্চের আলো দেখতে পায়।
‘মেরভে! ইরেম! আপনারা কি আলো দেখতে পাচ্ছেন? ঠিক আছে, এখন আমি একটি ছোট ক্যামেরা নামাচ্ছি। এটা দেখতে পেলে আমাদের বলবেন, আর এরপর কী করতে হবে, আমরা তা বলব।’
এ সময় হাসান তার নাইট ভিশন ক্যামেরার ছোট পর্দায় দলের আর সবার সঙ্গে মেয়েদের দেখতে এলেন। তারা সবাই মেরভে ও ইরেমকে দেখতে পেলেন। তারা দেখলেন ক্যামেরার পর্দায় দুই বোন হাসছে। দলের সবার চেহারায় দেখা গেল প্রশান্তি।
ভোর পাঁচটায় হামাগুরি দিয়ে মেয়েদের কাছে পৌঁছানোর মতো একটি টানেল খোঁড়া হয়ে গেল। এ সময় একজন উদ্ধারকর্মী কয়েক মুহূর্তের জন্য ইরেমের হাত ছুঁয়ে দেখতে পারলো।
কয়েকদিন ধরে মায়ের মরদেহের পাশে থাকা ইরেম উদ্ধারকর্মীদের জানালেন, ‘আমাদের মায়ের শরীর পচতে শুরু করেছে আর এর কারণে আমরা ঠিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’
কমান্ডার হাসান এ সময় অপেক্ষায় থাকা দুই বোনের বন্ধুদের বললেন মেরভে ও ইরেমের একটি ছবি দেওয়ার জন্য যাতে তাদের দেহের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
‘সব ঠিক আছে, আমরা তাদের বের করে আনতে পারবো’ বলে ওঠলেন উদ্ধারকর্মীরা। মেডিকেল টিম এসময় থার্মাল কম্বল আর স্ট্রেচার নিয়ে তৈরি হলো। এ সময় সবার মধ্যে সৃষ্টি হলো টানটান উত্তেজনা।
ভোর সাড়ে ছয়টায় ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে প্রথমে বের হয়ে এলেন ইরেম। এ সময় একই সঙ্গে হাসতে ও কাঁদতে লাগলেন তিনি। বের হয়েই তিনি উদ্ধারকর্মীদের বললেন, ‘আল্লাহ আপনাদের বাঁচিয়ে রাখুন। দয়া করে মেরভেকেও বাঁচান।’ হাসান তাকে বললেন, ‘মেরভেও বের হয়ে আসবে, আমি প্রতিজ্ঞা করছি।’
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2023/02/12/tursk-dui-bon-skrin-shtt.jpg)
তবে মেরভেকে বের করে আনতে আরও আধা ঘণ্টা সময় লাগলো। যখন মেরভে বে হয়ে আসলেন প্রত্যেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠল, হাততালি দিতে লাগল। মেরভে জঞ্জালের নিচ থেকে বের হয়েই বললেন, ‘সত্যি আমি বেঁচে আছি?’
মুস্তাফা হেসে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ প্রিয়, আপনি বেঁচে আছেন।’