ফেলানী হত্যাকাণ্ড : সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া
ফেলানী হত্যাকাণ্ড নিয়ে এবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে চলেছে সর্ব ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া’। আগামী ১৩ জুলাই সংগঠনটির পক্ষ থেকে দিল্লি সুপ্রিম কোর্টে এ বিষয়ে আপিল করা হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার সম্পাদক সুশান্ত সরকার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ফেলানী হত্যার বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের মানুষের বিবেকের ওপর এ এক চরম আঘাত। এই ধরনের হত্যা কখনই ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। বিশেষ করে ফেলানীকে হত্যার পর তার লাশ যেভাবে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্য সমগ্র বিশ্ববাসী দেখেছে,তা অত্যন্ত অমানবিক। যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্দশন। ফলে ভারত-বাংলাদেশ প্রতিবেশী দুই দেশের মানুষের আবেগেও ফেলানী হত্যার মর্মান্তিক ছবি একটি বড় ক্ষত সৃষ্টি করেছে। যে কারণে আমরা ফেলানী হত্যার বিষয়টি নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে একটি মানবিক আবেদন জানাচ্ছি। আশা করা যায়,আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।’
আপিল করতে আগামী ৮ জুলাই সংগঠনের প্রতিনিধিরা কলকাতা থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেবেন বলে জানান সুশান্ত।
এই মানবাধিকারকর্মী আরো জানান, আপিলের পাশাপাশি তাঁরা ভারতীয় আইনে তথ্য জানার যে অধিকার আছে তার ওপর ভিত্তি করে পুরো ঘটনা প্রকাশ্যে নিয়ে আসার দাবিও তুলবেন। আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে ফেলানী হত্যাকাণ্ড নিয়ে কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের উপদূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলেও জানিয়েছেন সুশান্ত সরকার।
উল্লেখ্য,২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার ফুলবাড়ির অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফের) গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী খাতুন। এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে দেশে-বিদেশে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। ফলে চাপের মুখে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট বিএসএফ নিজেদের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের জেলার বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু করে। কিন্তু ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিএসএফের বিশেষ আদালত ফেলানী হত্যায় মূল অভিযুক্ত বিএসএফ জওয়ান অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেন।
এরপর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিএসএফের এক যৌথ বৈঠকে ফের ফেলানী হত্যার পুনর্বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনর্বিচার শুরু হলেও বারবার এই মামলা মুলতবি হয়ে যায়।
দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে বিএসএফের বিশেষ আদালতে বিএসএফ কর্মকর্তা সি পি ত্রিবেদীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এক বিচারক বোর্ড গত ২ জুলাই ফের অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করে। যদিও এই চূড়ান্ত রায়ে বিএসএফের মহাপরিচালকের অনুমতি প্রযোজ্য।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে ফেলানী হত্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের শীর্ষ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অ্যামনেস্টির শীর্ষ কর্তা সুশান্ত সরকার বলেন,‘খুব শিগগিরই আমরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছি। ফেলানী হত্যায় ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন ঘোষণাও লঙ্ঘন করা হয়েছে। ওই ঘোষণাপত্রে জীবন,ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে তাও লঙ্ঘিত হলো। ভারতীয় সংবিধানে ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারকে মানবাধিকার বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এশিয়াড মামলায় তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং ফেলানী হত্যার পর তার মরদেহ যেভাবে সীমান্তের কাঁটাতারে দীর্ঘ সময় ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল তা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।’
সুশান্ত সরকার আরো বলেন, হুসেনে আরা খাতুন বনাম বিহার রাজ্য মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নারীদের মানবাধিকার রক্ষায় উল্লেখযোগ্য রায় দিয়েছেন। তাই আমরা ফেলানী হত্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ আদালতে আবেদন জানাতে চলেছি। তাঁর কথায়, একই মামলায় রিভিশন ট্রায়াল কেন? তাহলে কি অন্য কোনো কারণ আছে! এটাও দুই দেশের মানুষ জানতে চায়।
একইসঙ্গে অ্যামনেস্টির শীর্ষকর্তা বলেন,‘মৃত ব্যক্তিরও সম্মান আছে, কিন্তু ফেলানী হত্যার পর সেই সম্মানটুকুও চিরতরে মানবাধিকারের অভিধান থেকে মুছে গেল! মানবাধিকারের এই চূড়ান্ত লাঞ্ছনার ঘটনায় তাই ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া।’
এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শুধু ভারতে নয়,বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো জায়গায় ঘটলে তারা তাদের সাধ্যমতো প্রতিবাদ জানাবে বলেও জানান সুশান্ত।