যেসব কারণে হারলেন কমলা হ্যারিস
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষে বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতি, অভিবাসন ও চলতি দায়িত্ব–এই তিনটি বিষয়কে কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এসব কারণেই কমলা হ্যারিস হোয়াইট হাউসে পুনরায় প্রবেশের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আটকাতে পারেননি। বিশ্লেষণের সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা হলো–
অর্থনৈতিক অস্বস্তি
ডেমোক্র্যাটিক কৌশল প্রণয়নকারী জেমস কারভিল ১৯৯২ সালে বিল ক্লিনটনের বিজয়কে খুব জনপ্রিয় একটি বাগধারার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, আর তা হলো, ‘বোকা অর্থনীতি’। আর এর প্রায় ৩০ বছর পর আবারও সেই ধারাটি যেন ফিরে এলো। হোয়াইট হাউসে জো বাইডেনের সঙ্গে ক্ষমতায় থেকে কমলা হ্যারিস মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত মার্কিন ভোটারদের মন জয় করতে ব্যর্থ হলেন। ডেমোক্র্যাটদের এই অপূরণীয় ক্ষতি সারা বিশ্বজুড়ে অতিমারী পরবর্তী মূল্যস্ফীতিতে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবির সমার্থক হয়েই যেন দেখা দিল।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সাম্প্রতিক সূচকগুলো উন্নতির ধারায় কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন জরিপে ভোটারদের নেতিবাচক মানসকিতাই যেন প্রতিফলিত হচ্ছে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারণায় বারবার গৃহস্থালি পণ্যের পাশাপাশি জ্বালানির দামের ঊর্ধ্বগতিকেই সবার সামনে তুলে ধরেছেন।
এ বিষয়ে অক্সফোর্ড ইকোনোমিক স্কুলের বার্নার্ড ইয়ারোস বলেন, জনগণ এখনও মূল্যস্ফীতিকে একটি সমস্যা হিসেবেই দেখে, কেননা তারা অর্থনীতিবিদদের মতো বছর ধরে চিন্তা করে না, তারা পণ্যের মূল্যটাকেই মুখ্যভাবে দেখে।
ইয়ারোস আরও বলেন, লোকজন নিজেদের দুর্দশাগ্রস্ত মনে করেন, যখন তারা দেখে গৃহস্থালির বাজেটের একটি বড় অংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান দিতে খরচ হয়ে যাচ্ছে।
অভিবাসী ইস্যু
২০১৬ সালের আপসেটের পর ২০২৪ সালেও অভিবাসী ইস্যুটি একটি পরিষ্কার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য, এমনটা মনে করেন রিচমন্ড ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক কার্ল টোবিয়াস। এবার বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের বদৌলতে যুক্তরাষ্ট্রে আসা লাখ লাখ অভিবাসীকে গণহারে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে ব্যাপক অভিযান চালাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প।
জো বাইডেনের নির্বাহী আদেশ জারি হওয়ার পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরুনোর বিষয়টি মারাত্মক আকার ধারণ করে। গত বছর এই সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা এটিকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে অভিহিত করেন।
কমলা হ্যারিসের প্রশাসনিক কাজে মার্কিন অভিবাসনের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কমলা যুক্তি দিয়েছিলেন যে ট্রাম্প রাজনৈতিক লাভের আশায় রিপাবলিকানদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে দ্বিদলীয় সীমান্ত বিলকে আটকে দিয়েছিলেন। রিপাবলিকানরা যুক্তি দিয়েছিল সীমান্ত বিল দেরি করে উত্থাপিত হয়েছিল এবং তা ছিল সংক্ষিপ্ত। তবে যাই হোক না কেন ভোটাররা ট্রাম্প শিবিরের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে।
জনসংখ্যাগত পরিবর্তন
প্রাথমিক বুথ ফেরত জরিপে দেখা গেছে ৪০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ভোটার কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়েছে। পাশাপাশি তিনি ৮০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার এবং প্রায় অর্ধেক হিস্পানি ও এশীয় ভোটারদের সমর্থন পেয়েছেন। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প অশ্বেতাঙ্গ কোনো জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ ভোট পাননি। একই জরিপ অনুসারে, তার প্রতি আফ্রিকান আমেরিকানদের সমর্থন বেড়েছে এক অঙ্কের কোটায় আর দুই অঙ্কের কোটায় পৌঁছে হিস্পানিদের সমর্থন, যা ডেমোক্র্যাটদের জন্য খুবই উদ্বেগের।
সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বরার্তো সুরো বলেন, আমরা দেখেছি, মেক্সিকান আমেরিকান পুরুষ, ধর্মপ্রচারক, কলেজ শিক্ষিত নয় এমন লোক, কর্মজীবী মানুষ সবাই ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
এ ছাড়া ২০২০ সালের চেয়ে নারীদের ভোট আদায়ে ট্রাম্প ভালো করেছেন, যদিও গর্ভপাত ইস্যুটি নির্বাচনের প্রচারণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এ ছাড়া যুবা শ্রেণির ভোটারের দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি।
দেরিতে দৃশ্যপটে আসা
গত বছর জো বাইডেন যখন পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন, তখন থেকেই অনেক ডেমোক্র্যাটে তার ৮২ বছর বয়স নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দলের মধ্য থেকে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না আসায় এবং হোয়াইট হাউস থেকে বাইডেনের বয়স নিয়ে নেতিবাচক কথার প্রতিবাদ চলতে থাকায় তিনিই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী নির্বাচিত হন। তবে জুন মাসে ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে বাইডেনের পারফরম্যান্স তার জন্য শঙ্কার সৃষ্টি করে ও মানসিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। এরপরই দৃশ্যপটে আসেন কমলা হ্যারিস। কিন্তু মাত্র তিন মাস আগে তিনি দলের মনোনয়ন পান। আর তিন মাস এই নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ পান তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যারি সাবাতো বলেন, ডেমোক্র্যাটদের এই বিপর্যয়ের জন্য জো বাইডেনকেই দায়ী করা হয়। বাইডেন তার ৮০ বছর বয়স চলার সময়েও কখনো বলেননি, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে লড়বেন। আর এ কারণেই নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে খুব কম সময় পান কমলা হ্যারিস, যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
বাইডেনের বোঝা
জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার স্রোত থেকে কমলা হ্যারিস নিজেকে আলাদা করার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি। আর এক্ষেত্রে ৮ অক্টোবর এবিসি টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে নিজের জালেই যেন আটকা পড়েন। চ্যাট শো ‘দি ভিউ’য়ে কমলার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি বাইডেনের চেয়ে কোন কাজটি আলাদাভাবে করতে চান। উত্তরে কমলা বলেন, ‘আমার এই মুহূর্তে কিছু মনে আসছে না।’
কমলার এই উত্তরটি একজন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করে তার সমর্থকদের মনে, এমনটাই বলেছেন বারাক ওবামার সাবেক উপদেষ্টা ডেভিড এক্সেলরড। আর বাইডেনকে সহজ প্রতিযোগী মনে করা ট্রাম্প এই সুযোগটি নিতে পিছপা হননি। তিনি তার অনেক নির্বাচনি সমাবেশে এই ক্লিপটি বাজিয়ে শোনান এবং টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে তুলে ধরেন।