সত্যিই কি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে ইরান?
ইরানের একজন আইনপ্রণেতার উদ্ধৃতি দিয়ে দেশটির সরকারি প্রেস টিভি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরায়েলের হামলার পর ইরান পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি তেল পরিবহণ পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
ইরানের পার্লামেন্ট সদস্য ইসমাইল কৌসারির উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছে, যার ফলে বৈশ্বিক তেল সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে। কৌসারি বলেন, ‘ইরান পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি আটকে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে যেখান দিয়ে দৈনিক প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল সরবরাহ হয়ে থাকে।’
গত শুক্রবার (১৩ জুন) ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা চালানোর পরপরই ইরানের পক্ষ থেকে এ ধরনের মন্তব্য পাওয়া গেল।
ইসরায়েলি হামলায় ইরানে কমপক্ষে ৭৮ জন নিহত ৩২০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়। এর পাল্টা জবাব দিতে ইরান ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এসব হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে সাতজন নিহত হয় ও আহত হয় ১৭০ জনেরও বেশি মানুষ। দেশ দুটোর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো থেকে হতাহতের এই সংখ্যা পাওয়া গেছে।

তাই সংঘাত শুরু পর থেকেই সবাই আশঙ্কা করছে যে তেহরান পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই জ্বালানি সরবরাহ পথটি বন্ধ করে দিতে পারে।
হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। আর এপথেই পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ তেল ও তেল জাতীয় পণ্য সরবরাহ হয়ে থাকে। আর যদি এই সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে তা পুরো বিশ্বের জ্বালানি বাজারকেই টালমাটাল করে তুলবে।
তবে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থা নিয়ে যারা কাজ করে থাকেন তারা বিশ্বাস করেন, বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহের এই পথটি বন্ধ করা না-ও যেতে পারে, কেউ কেউ মনে করেন, বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।
এ বিষয়ে ট্রান্সভারসাল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রেসিডেন্ট অ্যালেন ওয়াল্ড বলেন, তেল সরবরাহের এই পথ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইরানের সবচেয়ে বড় মিত্র চীন। চীন চাইবে না পারস্য উপসাগর হয়ে তেলের সরবরাহ পথ বন্ধ হয়ে যাক। তারা এটাও চাইবে না তেলের দাম বেড়ে যাক। সুতরাং, এক্ষেত্রে চাপটা ইরানের ওপরই বেশি পড়বে। চীন হলো ইরানের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশ। ইরানের মোট তেল রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশই যায় চীনে। পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারও বটে। তাই হরমুজ প্রণালি যদি বন্ধ হয়, তবে ইরানের শত্রুর চেয়ে মিত্রদের ওপরই প্রভাব পড়বে বেশি। আর এ কারণেই ধরে নেওয়া যায় ইরান এই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথ বন্ধ করতে চাইবে না।
পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরের সংযোগস্থল হরমুজ প্রণালির দৈর্ঘ্য ৫৫ থেকে ৯৫ কিলোমিটার। তবে এর বেশ অনেকটাই পড়েছে ওমানের সীমান্তে। সুতরাং বলা যায়, ইরানের একক প্রচেষ্টায় তা বন্ধ হচ্ছে না। তেল পরিবহণের ট্যাংকারগুলো যদি চায় ইরানের সীমানা এড়িয়ে চলবে সেক্ষেত্রে সেগুলো ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের জলসীমা ব্যবহার করতে পারবে।
আর শেষ পর্যন্ত যদি ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধই করে দেয় সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তাই হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া ইরানের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে।
এ ছাড়া বাহরাইনে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর ইরানের জন্য একটি বড় চিন্তার বিষয়। ইরান হয়তো তেলের ট্যাংকাগুলোতে হামলা করতে পারে বা প্রণালিজুড়ে জলমাইন বসিয়ে জাহাজ চলাচলের পথে সাময়িক বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগে থেকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন ইরান যদি পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে কোনো চুক্তিতে না পৌঁছায় তবে দেশটি মার্কিন সামরিক তৎপরতার মুখে পড়বে। আর ঠিক এই মুহূর্তে ইরানও চাইবে না যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে জড়াতে।