ইরান কি সত্যিই পারমাণবিক বোমা তৈরির ‘খুব কাছাকাছি’?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ‘খুব কাছাকাছি’। গত মঙ্গলবার (১৭ জুন) কানাডায় জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলন থেকে দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
গত শুক্রবার (১৩ জুন) থেকে ইসরায়েল ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে এবং কমপক্ষে ১৪ জন ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী বলেছে, এই বিজ্ঞানীরা ‘ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন। এদের নির্মূল করা ইরানের গণবিধ্বংসী অস্ত্র অর্জনের ক্ষমতার ওপর একটি উল্লেখযোগ্য আঘাত’।
ইরান সবসময় জোর দিয়ে বলে এসেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যে দাবি করে এসেছেন, ট্রাম্পের সোমবারের মন্তব্যে তা প্রতিধ্বনি হয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় প্রথম দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর গত শুক্রবার নেতানিয়াহু বলেন, ‘সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইরান এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আগে কখনও নেয়নি। আর তা হলো সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে অস্ত্রে রূপান্তরের পদক্ষেপ।’
তাহলে কি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর দাবি অনুযায়ী ইরান সত্যিই পারমাণবিক বোমা তৈরির কাছাকাছি? ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আনা গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার ভুয়া অভিযোগের সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কি কোনো মিল আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা পর্যবেক্ষক ও জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তথ্য ও মূল্যায়নে কী বলা হয়েছে, জেনে আসা যাক।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কী বলে?
গত ২৫ মার্চ ট্রাম্পের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের স্পষ্টভাবে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে না।
তুলসি গ্যাবার্ড বলেন, ‘গোয়েন্দা সম্প্রদায় মূল্যায়ন করে দেখেছে যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ২০০৩ সালে স্থগিত করা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির অনুমোদন দেননি।’
তুলসী গ্যাবার্ড আরও বলেন, ‘ইরানে জনসমক্ষে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনা করার উপর কয়েক দশক ধরে চলে আসা নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটেছে, এতে সম্ভবত ইরানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের সমর্থকরা উৎসাহিত হয়েছেন।’
‘ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে এবং পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন একটি রাষ্ট্রের জন্য এটি নজিরবিহীন’, বলেন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড।
সোমবার যখন সাংবাদিকরা ট্রাম্পের কাছে তুলসী গ্যাবার্ডের বিবৃতি উদ্ধৃত করেন, তখন তিনি বলেন, ‘তিনি কী বললেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার মনে হয় তারা পারমাণবিক অস্ত্র রাখার খুব কাছাকাছি। ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারবে না। এটা খুবই সহজ।’
ট্রাম্পের এই সর্বশেষ মন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে গ্যাবার্ড সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট একমত, তবে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে তাদের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নের কারণ ব্যাখ্যা করেননি।
মার্কিন সামরিক বাহিনী কী মনে করে?
গত ১০ জুন ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণ শুরুর তিন দিন আগে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের কমান্ডার এরিক কুরিলা এক সিনেট কমিটিকে বলেছেন, তেহরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির দিকে এগোচ্ছে’। তিনি বলেন, ‘বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির আড়ালে দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থাপনায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত করা হচ্ছে। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন অব্যাহত রেখেছে।’
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কী এবং ইরান কী করছে?
ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। এটি আইএইএ ও তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমালোচকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ হলো প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের ঘনত্ব বৃদ্ধির প্রক্রিয়া, যেখানে সাধারণত মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ ইউ-২৩৫ থাকে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে হলে, ইউরেনিয়ামকে প্রায় ৯০ শতাংশ ইউ-২৩৫ সমৃদ্ধ করতে হবে। একবার এই স্তরে সমৃদ্ধ হয়ে গেলে ইউরেনিয়ামকে ‘অস্ত্র গ্রেড’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একবার ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ করা হলে এটি অস্ত্র গ্রেডে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় সময় কমে যায়। যে কারণে উচ্চতর সমৃদ্ধকরণের মাত্রা আইএইএ এর মতো পর্যবেক্ষকরা আরও বেশি নজরদারি প্রয়োজন মনে করে।
ইরান বরাবরই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের কথা অস্বীকার করে এসেছে। তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিকাশের বৈধ অধিকার দাবি করে।
আইএইএ কি মনে করে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে?
গত ৯ জুন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ সংস্থার বোর্ড অব গভর্নরদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে আইএইএ এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, ইরান ৪০০ কেজি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত করেছে।
রাফায়েল গ্রোসি আরও বলেন, ‘যদিও সুরক্ষিত সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ নয়, তবুও ইরান বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন রাষ্ট্র, যারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন ও সঞ্চয় করছে, তা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের হামলার একদিন আগে বৃহস্পতিবার আইএইএ বোর্ড তেহরানের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে এবং জাতিসংঘের কাছে সুরক্ষা-সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। তবে গত মঙ্গলবার সিএনএন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গ্রোসি জোর দিয়ে বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইরানের পদ্ধতিগত প্রচেষ্টার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।’
ইরান কি শিগগিরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে?
গত ১০ জুনের কুরিলা দাবি করেন, যদি ইরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির’ সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে তাদের কাছে এক সপ্তাহে ২৫ কেজি পর্যন্ত অস্ত্র গ্রেড ইউরেনিয়াম তৈরির পর্যাপ্ত মজুত ও সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, যা তিন সপ্তাহে ১০টি অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট। তবে মঙ্গলবার (১৭ জুন) সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্রোসি একটি ভিন্ন সময়সীমা অনুমান করেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, এটা আগামীকালই সম্ভব না, হয়তো বছরের পর বছরও লাগবে না। আমি মনে করি না, এর জন্য বছরের পর বছর প্রয়োজন হবে না।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অলাভজনক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অস্ত্র বিস্তার রোধ নীতির পরিচালক কেলসি ডেভেনপোর্ট বলেন, ‘ইসরায়েলও জানে, ইরানের কাছে বোমা তৈরির কোনো সক্ষমতা নেই। যদি সত্যিই আসন্ন (পারমাণবিক অস্ত্র) তৈরির ঝুঁকি থাকে, যদি ইসরায়েল সত্যিই ভেবে থাকে—ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে, আমার মনে হয় ফোর্দো ও নাতানজে পারমাণবিক অবকাঠামোর কার্যক্রম ব্যাহত করার জন্য আরও অনেক বেশি ধারাবাহিক অভিযান চালানো হতো।’

বর্তমান বিতর্কে কি ২০০৩ ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ভুয়া অভিযোগের প্রতিধ্বনি হচ্ছে?
মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু পর্যবেক্ষকের মতে, এটি করা হচ্ছে।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আক্রমণের আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দাবি করেছিল ইরাকের কাছে রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রসহ গণবিধ্বংসী রয়েছে এবং তারা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য আসন্ন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশটিতে সামরিক অভিযানের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য এই দাবিগুলো করা হয়েছিল। ২০০২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দাসহ তৎকালীন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেছিল।
আক্রমণের পর ব্যাপক অনুসন্ধানেও ইরাকে সক্রিয় কোনো গণবিধ্বংসী কর্মসূচির সত্যতা পাওয়া যায়নি। পরে মার্কিন সিনেট গোয়েন্দা কমিটি এবং যুক্তরাজ্যের তদন্ত সংস্থা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, গোয়েন্দা তথ্যে গভীর ত্রুটি ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা ইরাকে আক্রমণের পক্ষে যুক্তি তৈরি করতে দেশটির ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত ও রাজনীতিকরণ করেছিলেন।