নতুন বাণিজ্যযুদ্ধে জড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন : বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক আবারও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন চীনের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হবে তা স্পষ্টভাবে জানে না।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার সূত্রপাত হয় ৯ অক্টোবর, যখন বেইজিং বিরল খনিজ (রেয়ার আর্থ) রপ্তানিতে নতুন সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। এ তালিকায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত করা হয়েছে।
এই বিরল খনিজগুলো ইলেকট্রিক যানবাহন, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে ব্যবহৃত হয় এবং এদের অধিকাংশ মজুদ ও প্রক্রিয়াকরণ সুবিধা রয়েছে চীনের হাতে। খবর আল জাজিরার।
চীন এবার প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেছে, কোনো দেশ যদি চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বা চীন থেকে সংগৃহীত উপাদান দিয়ে বিরল খনিজের চুম্বক বা সেমিকন্ডাক্টর সামগ্রী তৈরি করে, তবে সেগুলো রপ্তানির জন্য বিশেষ লাইসেন্স নিতে হবে।
চীনের এই পদক্ষেপ আসে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র তার এনটিটি লিস্ট (যেখানে নির্দিষ্ট বিদেশি কোম্পানি ও ব্যক্তির ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়) সম্প্রসারণ করে, ফলে চীনের উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র চীন-সম্পৃক্ত জাহাজের ওপর কর আরোপ করে এবং চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকান মালিকানাধীন ও পরিচালিত জাহাজের ওপরও শুল্ক আরোপ করে।
কানাডার এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিনা নাজিবুলা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপগুলো সরাসরি বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বরং এটি এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের লড়াই।”
ভিনা আরও বলেন, “এটি এখন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ — যেখানে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপের জবাব দিতে প্রস্তুত। আগের মতো আর একতরফা চাপে থাকবে না।”
অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল গ্লোবাল চায়না হাবের ফেলো ডেক্সটার টিফ রবার্টস বলেন, “চীন এখন বুঝে গেছে যে তাদের হাতেই এখন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক লিভারেজ বা প্রভাব ক্ষমতা বেশি। তাই আসন্ন ট্রাম্প–শি জিনপিং বৈঠকের আগে তারা কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।”
রবার্টস বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন এখন অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। তারা একদিকে চীনের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছে, আবার কয়েক দিনের মধ্যেই সেই নীতি থেকে সরে আসছে। এতে বোঝা যায়, তারা আসলে জানে না কিভাবে চীনের সঙ্গে লড়তে হবে।”
তার মতে, চীন জানে ট্রাম্প একটি বড় চুক্তি চায় এবং তার “ডিলমেকার” ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চায়, আর এই সুযোগেই বেইজিং চাপ বাড়াচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক ওয়েই লিয়াং বলেন, ট্রাম্পের একটি “টিএসিও” (ট্রাম্প অলওয়েজ চিকেনস আউট — অর্থাৎ ট্রাম্প শেষ মুহূর্তে পিছু হটেন) ইতিহাস রয়েছে।
লিয়াং বলেন, “ট্রাম্প শেয়ারবাজারের প্রতিক্রিয়াকে অন্য যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন, তাই প্রয়োজনে ছাড় দিতেও দ্বিধা করেন না।”
লিয়াং আরও বলেন, চীনের এই কঠোর অবস্থান তার নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপেও এসেছে। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর, বেকারত্ব বেড়েছে এবং শুল্কের কারণে রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে শি জিনপিং এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছেন দেশের জনগণকে বোঝাতে যে “সমস্যার মূল ট্রাম্পের নীতি, চীনের নয়।”
বিশ্লেষকদের মতে, চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা’–এর দিকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রস্তুত।
চীন গত কয়েক বছরে তার রপ্তানি বাজার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)–এর আওতায় আফ্রিকা, ইউরোপ, ওশেনিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে তারা এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তেমন নির্ভরশীল নয়।
এমনকি সয়াবিন, বিমান ও উন্নত চিপ সরঞ্জামের মতো পণ্যেও তারা বিকল্প উৎস খুঁজে নিয়েছে বা নিজস্ব প্রযুক্তি উন্নয়ন করেছে।
ভিনা নাজিবুলা বলেন, “চীন যেভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়েছে, অন্য দেশগুলোকেও সেইভাবে প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল। এখনই সময় সবাইকে তাদের সরবরাহ উৎস বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে, কারণ চীনের কৌশল এখন পরিষ্কার।”

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক