চীনের সহযোগিতায় একের পর এক অঞ্চল দখল করছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার
চীন সীমান্তে কয়েক মাস ধরে কঠিন লড়াইয়ের পর মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে কিয়াউকম শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এটি ছিল বিদ্রোহীদের জন্য এক বড় জয়। কারণ চীন সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের বাকি অংশে যাওয়ার প্রধান বাণিজ্য রুট এ অঞ্চলটিই। কিয়াউকম শহরটি এশিয়ান হাইওয়ে ১৪-এর ওপর অবস্থিত। খবর বিবিসির।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিয়াউকম ‘বার্মা রোড’নামে বেশি বিখ্যাত ছিল। তা আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এ শহর দখল করার পর বিরোধীদের জন্য এটিকে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হিসেবে মনে করেছিলেন। তবে এ মাসেই মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে সেনাবাহিনী কিয়াউকম বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পুনর্দখল করেছে। এই ছোট পাহাড়ি শহরের দখল-পুনর্দখল স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক ভারসাম্য এখন জান্তার অনুকূলে কতটা সরে গেছে।
কিয়াউকম অঞ্চলকে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। টিএনএলএর নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে সামরিক বাহিনী প্রায় দিনই সেখানে বিমান হামলায় চালিয়েছে। জান্তা বাহিনীর হামলার তীব্রতায় শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই পালিয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য সামরিক বাহিনী শহরটি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করার পর এখন তাঁরা ফিরতে শুরু করেছেন।
টিএনএলএর এক মুখপাত্র টার পার্ন লা চলতি মাসের শুরুতে বিবিসিকে বলেন, ‘কিয়াউকম ও হিসিপাওতে প্রতিদিন তীব্র লড়াই চলছে। বিদ্রোহীদের তুলনায় সেনাবাহিনীর বেশি সেনা, ভারী অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান রয়েছে। আমরা হিসিপাওকে রক্ষা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
এভাবে চীন সীমান্তের রাস্তায় জান্তা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। চীনের সমর্থন থাকার কারণেই জান্তা বাহিনী এসব শহর পুনর্দখল করতে পেরেছে। চীন আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে জান্তার পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। তবে দেশে-বিদেশে এই পরিকল্পনার ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কারণ, এই নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে (এনএলডি) বাদ দেওয়া হয়েছে। এনএলডি মিয়ানমারে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। জান্তা বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকারকে উৎখাত করেছিল। তখন থেকে মিয়ানমারের বেশির ভাগ অংশেই গৃহযুদ্ধ চলছে।
জান্তা সরকার বিরোধীদের সস্তা ড্রোন ব্যবহারের প্রাথমিক সুবিধার জবাবে চীন থেকে হাজার হাজার আধুনিক ড্রোন কিনেছে। তাদের অগ্রবর্তী ইউনিটগুলোকে এসব অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জান্তা বাহিনী ধীর ও সহজে উড়তে পারা মোটরচালিত প্যার্যাগ্লাইডারও ব্যবহার করছে, যা হালকাভাবে সুরক্ষিত এলাকার ওপরে চক্কর দিতে পারে এবং অত্যন্ত নির্ভুলভাবে বোমা ফেলতে পারে। তারা চীনা ও রাশিয়া থেকে পাওয়া বিমান দিয়ে অবিরাম বোমা ফেলছে।
কেবল বিদ্রোহী গোষ্ঠী টিএনএলএ পিছু হটেনি। গত এপ্রিলে চীনের প্রবল চাপের পর ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের এক মিত্র গোষ্ঠী এমএনডিএএ লাশিও ছেড়ে দেয়। গত বছর বিদ্রোহীরা এ এলাকা দখল করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এমএনডিএএ এখন জান্তার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। শান রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অস্ত্রসজ্জিত ইউডব্লিউএসএ গোষ্ঠীও চীনের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছে। তারা মিয়ানমারের অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে।
সীমান্ত অঞ্চলে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ওপর চীন প্রভাব খাটিয়ে ‘অপারেশন ১০২৭’দুই বছর আগে বন্ধ করতে পারত। সে সময় নিশ্চিতভাবেই ‘অনলাইন প্রতারণাকেন্দ্র’নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি হতাশার কারণে চীন তা করেনি। তবে এখন চীন জান্তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে। তারা নির্বাচনের জন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি এবং প্রকাশ্যে কূটনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। এ বছর জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং এবং শি চিন পিংয়ের মধ্যে দুই দফা বৈঠকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান ও এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি নিয়ে চীনের অস্বস্তি সত্ত্বেও এ বৈঠক করা হচ্ছে।
মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ সুবিদিত। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। মিয়ানমারকে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের জন্য তেল ও গ্যাস সরবরাহের রুট হিসেবে দেখা হয়। অনেক চীনা কোম্পানির মিয়ানমারে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। অন্য কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ মিয়ানমারে কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসনকে শক্তিশালী করার চীনের এ উদ্যোগকে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ সমর্থন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক