রেকর্ড দামে নেটফ্লিক্সের হবে ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’, আলোড়িত হচ্ছে যে পাঁচ বিষয়
হলিউডের ইতিহাসে বিশাল চুক্তিতে স্ট্রিমিং জায়ান্ট নেটফ্লিক্স ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারির সিনেমা ও স্ট্রিমিং ব্যবসা ৭২ বিলিয়ন ডলারে কিনতে রাজি হয়েছে। টাকার হিসাবে এর মূল্য প্রায় সাত লাখ ৯৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
টানা প্রতিযোগিতার পর নেটফ্লিক্স প্রতিদ্বন্দ্বী কমকাস্ট এবং প্যারামাউন্ট স্কাইড্যান্সকে পেছনে ফেলে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সফল দরদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই অধিগ্রহণের ফলে বিনোদন শিল্পে একটি নতুন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে চলেছে। খবর বিবিসির।
ওয়ার্নার ব্রাদার্স হলো— হ্যারি পটার, গেম অফ থ্রোনস ও স্ট্রিমিং পরিষেবা এইচবিও ম্যাক্স-সহ বিখ্যাত সব ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক। তবে এই চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার আগে প্রতিযোগিতা কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে।
এদিকে, রাইটার্স গিল্ড অফ আমেরিকাসহ চলচ্চিত্র শিল্পের কিছু ব্যক্তি এই চুক্তির সমালোচনা করে বলেছেন, এটি শ্রমিক ও গ্রাহকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারির মুভি স্টুডিও এবং জনপ্রিয় এইচবিও স্ট্রিমিং নেটওয়ার্ক কেনার জন্য নেটফ্লিক্সের চুক্তিটি হলিউডে বিশাল পরিবর্তন আনবে। তবে, এটি দেখতে সাধারণ একীভূতকরণ চুক্তির মতো হলেও এর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও প্রচুর নাটকীয় উপাদান রয়েছে।
যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখনো নীরব এবং এটি গল্পের শুরু মাত্র। গল্পটি উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চুক্তির পাঁচটি মূল দিক আলোড়ন তুলবে—
১. আরও শক্তিশালী হবে নেটফ্লিক্স
এই চুক্তি নেটফ্লিক্সের হলিউডে আধিপত্যকে আরও নিশ্চিত করবে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম স্ট্রিমিং সাবস্ক্রিপশন পরিষেবা ও নতুন কন্টেন্ট তৈরির বৃহত্তম প্রযোজক হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে অটুট রাখবে।
নেটফ্লিক্স প্রায় এক শতাব্দীর মূল্যবান সিনেমা ও শোর ক্যাটালগ এবং শক্তিশালী প্রযোজনা ক্ষমতা পাচ্ছে।
নেটফ্লিক্সের ৩০ কোটির বেশি গ্রাহকের সঙ্গে এইচবিওর ১২৮ মিলিয়ন গ্রাহকের কিছু অংশ যুক্ত হবে। গবেষণা সংস্থা ফরেস্টারের মাইক প্রউলক্স বলেছে, এইচবিও ম্যাক্স যোগ হলে নেটফ্লিক্স ‘অস্পৃশ্য’ হয়ে উঠবে।
লুনি টুনস, হ্যারি পটার, ফ্রেন্ডস, সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি, গেম অফ থ্রোনস-এর মতো বিখ্যাত ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এখন স্ট্রেঞ্জার থিংস্-এর মতো নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে আসবে।
এই চুক্তির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে টিএনটি স্পোর্টসও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২. দাম বাড়তে বা কমতে পারে
নেটফ্লিক্স আশা করছে, আগামী বছর থেকে ১৮ মাসের মধ্যে এই চুক্তি সম্পন্ন হবে। তবে এইচবিও ব্র্যান্ডকে বিদ্যমান নেটফ্লিক্স পরিষেবার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করা হবে, তা নিয়ে তারা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।
নেটফ্লিক্সের সহ-প্রধান নির্বাহী গ্রেগ পিটার্স বলেছেন, এইচবিও ব্র্যান্ডের নামটি ‘খুব শক্তিশালী’। আর এই নামটির কারণে তাঁদের কোম্পানির সামনে ‘অনেকগুলো বিকল্প’ তৈরি হবে।
দাম বাড়বে নাকি কমবে তা স্পষ্ট নয়। নেটফ্লিক্সের এই আধিপত্য গ্রাহকদের বেশি চার্জ করার সুযোগ দিতে পারে। তবে, দর্শকরা যদি দুটির বদলে একটি স্ট্রিমিং পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান করেন, তাহলে তাদের খরচ কম হতে পারে।
৩. স্ট্রিমিংয়েই বিনোদনের ভবিষ্যৎ, ঐতিহ্য হারাচ্ছে হলিউড
ওয়ার্নার ব্রাদার্স হলো হলিউডের একটি ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত স্টুডিও (যারা ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’ ও ‘দ্য এক্সরসিস্ট’-এর মতো ক্লাসিক তৈরি করেছে)। কিন্তু এই অধিগ্রহণ স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, সিনেমার স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে আসছে। বিশ্লেষক মাইক প্রউলক্সের মতে, ভবিষ্যৎ এখন পুরোপুরি স্ট্রিমিং-নির্ভর। তিনি বলেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত হলো- ঐতিহ্যবাহী মিডিয়ার যুগ শেষ হচ্ছে।’
নেটফ্লিক্স সিনেমা হলে ছবি মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষত ডিসি সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজি অধিগ্রহণের কারণে এই সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত, কারণ ডিসি সিনেমাগুলো হলে ভালো ব্যবসা করে।
এই একত্রীকরণ এমন একটি শিল্পের জন্য উদ্বেগের কারণ, যা ইতোমধ্যেই ছাঁটাই, প্রযোজনা হ্রাস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হুমকির সঙ্গে লড়াই করছে। টাইটানিকের পরিচালক জেমস ক্যামেরন এই চুক্তিকে ‘বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
৪. চুক্তিটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি
এই চুক্তি চূড়ান্ত হওয়া এখনো নিশ্চিত নয়। বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারিকে প্রথমে তাদের সিএনএন, ডিসকভারি ও ইউরোস্পোর্ট-এর মতো ব্যবসাগুলো আলাদা করে নিতে হবে।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্যারামাউন্ট স্কাইড্যান্স, যারা পুরো ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারি কিনতে চেয়েছিল, তারা শেয়ারহোল্ডারদের বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো— চুক্তিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রকদের অনুমোদন পাবে কিনা।
ওয়াশিংটনের আইন প্রণেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এই চুক্তি গ্রাহকদের জন্য কম পছন্দ ও উচ্চ মূল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
নেটফ্লিক্সের সহ-প্রধান নির্বাহী টেড সারান্দোস বলেছেন, অনুমোদন পাওয়ার বিষয়ে তারা ‘অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী’। যদি চুক্তিটি ভেঙে যায়, তবে নেটফ্লিক্সকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে।
অনুমোদনের বিষয়টি নির্ভর করবে নিয়ন্ত্রকরা কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক ল্যান্ডস্কেপকে সংজ্ঞায়িত করেন। যদি শুধু স্ট্রিমিং বাজারের দিকে নজর দেওয়া হয়, তবে নেটফ্লিক্সের অংশীদারত্ব বেড়ে যাওয়া উদ্বেগের কারণ হবে। কিন্তু কেবল টিভি, সম্প্রচার টিভি ও ইউটিউবকে প্রতিযোগী হিসেবে ধরলে এই উদ্বেগ কমতে পারে।
৫. ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেকটি ওয়াইল্ড কার্ড
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা এই চুক্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে পারে। যদিও তার প্রশাসন সাধারণত বড় ধরনের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে কম কঠোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ট্রাম্পের বরাবরই মিডিয়া ও বিনোদন শিল্পের প্রতি গভীর আগ্রহ রয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ট্রাম্প প্যারামাউন্ট স্কাইড্যান্সের মালিক ও রিপাবলিকান দাতা ল্যারি এলিসন এবং তাঁর ছেলে ডেভিডের প্রশংসা করেছেন— যারা ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে কেনার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি, তবে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিএনবিসিকে বলেছেন, তারা ওয়ার্নার ব্রাদার্সের জন্য নেটফ্লিক্সের বিডকে ‘তীব্র সংশয়’ নিয়ে দেখছেন।
বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন যে, ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, সেভাবে এই চুক্তিতেও বিভিন্নতা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতের মতো ইস্যুতে নেটফ্লিক্সের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক