সীমান্ত বাণিজ্যে স্থবির দর্শনা রেলপথ, অর্ধেকে নেমেছে রাজস্ব আয়
চুয়াডাঙ্গার দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন বন্দরে এখন আর নেই আগের কোলাহল ও কর্মব্যস্ততা। এক সময়ের কর্মচাঞ্চল্যে ভরা দর্শনা রেলইয়ার্ড এখন প্রায় নিস্তব্ধ। একসময় ট্রেনভর্তি পণ্য এসে খালাস হতো ইয়ার্ডে, এখন অল্প পরিসরে কিছু পণ্য এলেও তা খালাস হচ্ছে অন্যত্র। বর্তমানে শুধু ফ্লাই অ্যাশ আসছে, সেটাও স্বল্প পরিসরে। গত তিন মাসে মাত্র ৬-৭ রেক মাল এসেছে ভারত থেকে।
ভারত থেকে পণ্য আমদানি সহজ ও খরচ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা একসময় খুবই আগ্রহী ছিলেন এ বন্দরে। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে এখন স্থবির হয়ে পড়েছে দর্শনা রেলইয়ার্ড। ফলে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। যার ফলে রাজস্ব আহরণ অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে ১৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
কাজ না থাকায় শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। কেউ কেউ পেশা বদল করে অন্য কাজে যুক্ত হয়েছেন, অনেকে আবার কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় চলে গেছেন। তা সত্ত্বেও তাদের আশা, ব্যবসায়ীরা আবার ভারত থেকে বেশি বেশি পণ্য আমদানি করবেন। আর দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলইয়ার্ডে কাজের গতি ফিরবে।
একসময় ইয়ার্ডে শতাধিক ট্রাক থাকত পণ্য পরিবহণের জন্য, এখন হাতে গোনা ১০ থেকে ১৫টি ট্রাক দেখা যায়। ট্রাক ভাড়া না হওয়ায় মালিকরা বাধ্য হয়ে ট্রাক পাঠাচ্ছেন অন্যত্র। ট্রাক মালিকরা প্রতিমাসে লোকসান গুনছেন। চালক ও হেলপাররাও অলস সময় পার করছেন; কাজ না থাকায় তারাও ভোগান্তিতে রয়েছেন।
স্থানীয় শ্রমিক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার সময়ের মতো এখনো কাজ নেই। সারাদিন বসে থাকি, গাড়ি আসে না। ঘরে চুলা জ্বলে না ঠিকমতো।’
ট্রাকচালক টিটু মিয়া বলেন, ‘আগে দিনে দুই–তিন ট্রিপ দিতাম, এখন তিন দিনে একটা ট্রিপও হয় না।’
সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধি ও শ্রমিকরা আরও বলছেন, কার্যক্রম সচল থাকলেও কাজের পরিমাণ কমে গেছে। পণ্য ওঠানামা কমে যাওয়ায় আয়ও কমেছে। অনেক শ্রমিক কাজ হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন।
ভারত থেকে দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলপথ দিয়ে মালবাহী ওয়াগনে করে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতেন। দ্রুত সময়ে পণ্য খালাসের পর তা চাহিদামতো নির্দিষ্ট স্থানে সরবরাহ করা সম্ভব হতো।
কিন্তু সরকার পরিবর্তন ও ডলার সংকটের কারণে এখন ব্যবসায়ীরা এলসির মাধ্যমে চাহিদামতো পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। কিছু ব্যবসায়ী সামান্য পণ্য আমদানি করলেও তা খালাস হচ্ছে অন্যত্র।
রেলইয়ার্ডে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী ও চালকরা অলস সময় পার করছেন। কাজ না থাকায় অনেক শ্রমিক ইয়ার্ড ছেড়েছেন। আমদানি না হওয়ায় কাজ কমে যাওয়ায় অধিকাংশ সময় অফিসগুলো বন্ধ থাকে। ব্যবহার না হওয়ায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এলসি খুলতে এখন অনেক সময় ও খরচ লাগে। আগে অগ্রিম কিছু টাকা দিলেই এলসি হতো, এখন পুরো টাকা জমা না দিলে অনুমোদন মেলে না। আমাদের ক্ষতির পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও কমে যাচ্ছে। আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করলে পরিস্থিতি দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারে।’
আরেক ব্যবসায়ী রানা খান জানান, ‘আমদানির পরিমাণ প্রায় শূন্যে নেমে গেছে। ট্রেড লাইসেন্স আছে, শ্রমিক আছে, ট্রাক আছে কিন্তু কাজ নেই। মূলধন পড়ে আছে অচল অবস্থায়।’
রেলবন্দর সূত্রে জানা যায়, ভারত থেকে মালবাহী ওয়াগনে করে ভুট্টা, পাথর, পেঁয়াজ, চায়না ক্লে, ফ্লাই অ্যাশ, জিপসামসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হতো। এখন আসছে কেবল ফ্লাই অ্যাশ। সয়াবিন ভূষি আসছিল, আপাতত সেটাও বন্ধ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯,৭৪৯ ওয়াগনে ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৫৯ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়, যা থেকে রাজস্ব আয় হয় ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৮৬ ওয়াগনে ২ লাখ ৫২ হাজার ১০১ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়, যা থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে ১৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
নাম না প্রকাশের শর্তে রেলইয়ার্ডে থাকা কয়েকজন বলেন, করোনাকালীন সময়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলইয়ার্ড। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভারত থেকে ব্যবসায়ীরা আবার পণ্য আমদানি শুরু করেন। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিল, কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সবকিছুই থমকে যায়। কাজ না থাকায় আমরা কর্মহীন হয়ে পড়েছি। বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হতে হচ্ছে। আমরা চাই পরিস্থিতি আবার আগের মতো স্বাভাবিক হোক।
দর্শনা রেলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান হাবু বলেন, ‘আমাদের এখানে আপাতত রেলপথে পণ্য পরিবহণ নামমাত্র। কোনো গতিশীলতা নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করছেন।’
চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহসভাপতি শাহারিন হক মালিক বলেন, ভারত থেকে সহজে পণ্য আনতে দর্শনা রেলপথ ব্যবহার করতেন ব্যবসায়ীরা। নানা জটিলতার কারণে এখন তা বন্ধপ্রায়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও এলসি জটিলতা এর অন্যতম কারণ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ইয়ার্ডে প্রাণ ফিরবে না, ব্যবসায়ীদেরও লোকসান গুনতে হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলস্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট মির্জা কামরুল হক বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজস্ব আয় অর্ধেকে নেমেছে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। রাজস্ব কম হওয়ার কারণ ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে পণ্য আমদানি করছেন অল্প পরিসরে। আমদানি স্বাভাবিক হলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে ভারত থেকে ফ্লাই অ্যাশ আসছে। গত বছরের তুলনায় এ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা কম রাজস্ব আয় হয়েছে।

ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)