তামাকজাত পণ্যের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করুন

আজ ৩১ মে, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ দিবসটি উপলক্ষে এনটিভি স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৫২তম পর্বে আজকের অতিথি তামাকমুক্ত আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী।
প্রশ্ন : এবার এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়টি কী?
উত্তর : এ বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে তামাকজাত পণ্যের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করুন। অর্থাৎ সেসব তামাকগুলো আমাদের দেশের সীমান্ত দিয়ে আসে বা বিভিন্ন পথে আসে সেগুলোর ব্যবসা যেন বন্ধ হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে এই অবৈধ ব্যব্সার কারণে তরুণ যুবসমাজের মধ্যে তামাকটি বেশিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। অনেক সস্তা দামে তখন সিগারেট কিনতে পাওয়া যায়। সস্তা হলে মানুষ এটা বেশি কেনে, সহজলভ্য হয়। কিংবা যারা কৃষক বা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের জন্যও সিগারেটটা ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে চলে আসে। ফলে এর ব্যবহারই বেশি হয়।
আরেকটি হচ্ছে, সরকার এর করটা পায় না। কর ফাঁকি দেওয়া হয়, কারণ এটা অবৈধভাবে আসে। আরেকটি হচ্ছে, এভাবে তামাক ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অবৈধ কার্যক্রম ইত্যাদি বেশি হয়। সুতরাং অবৈধভাবে যখন কোনো জিনিস দেশে আসে সেটা বৈধভাবে সবকিছু হয় না। ফলে দেখা যায়, অবৈধ কার্যক্রম বেশি হয়। এ তিনটি জিনিসকে মাথায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবারের স্লোগান ঠিক করেছে ‘তামাকজাত পণ্যের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করুন’।urgentPhoto
প্রশ্ন : আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তামাকবিরোধী আইনের এখনকার অবস্থা কী রকম আমাদের দেশে?
উত্তর : ২০০৫ সালে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটা জাতীয় সংসদে পাস হয়। কিন্তু ওই সময়ে সে আইনে একটা ত্রুটি ছিল। তখন ধোঁয়াহীন তামাক অর্থাৎ নন স্মোকিং টোব্যাকো যেটা জর্দা, গুল, তুক্তা যার কারণে মুখের কিছু রোগ হয় বিশেষভাবে, সেগুলো ওই তামাকজাত আইনের মধ্যে যুক্ত ছিল না। তো এফটিসির যেটা হয়, জাতিসংঘে প্রায় ১৯০ দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয়- পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তামাকটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ তামাক এমন এক বস্তু যার কারণে মানুষের দেহে ২৫টি রোগ হতে পারে। সুতরাং এটা মানুষের ব্যবহারের মধ্যে সীমিত করতে হবে। সেই জন্য এফটিসিটির এই সীদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০৫ সালে তামাকজাত আইন পাস হয়। তবে সেখানে ধোঁয়াহীন তামাকজাত বস্তু যুক্ত ছিল না। বর্তমান সরকারের সময় ২০১৩ সালে এই এফটিসিটির আলোকে তামাকজাত আইনটা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়। ফলে এখন ধোঁয়াহীন তামাক এবং ধোঁয়াযুক্ত তামাক দুটোই আইনের ভেতরে। আগে একটি জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস) যদি কেউ ধূমপান করত এর জরিমানা ছিল ৫০ টাকা, এখন ৩০০ টাকা।
প্রশ্ন : কিন্তু সেটির খুব বেশি প্রয়োগ কি হচ্ছে?
উত্তর : হ্যাঁ হচ্ছে। আমরা হয়তো চোখে দেখতে পারছি না। আমাদের তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স যেটা আছে, সেটা ঢাকার বাইরে মফঃস্বল অঞ্চলে হরহামেশাই বিভিন্ন জায়গায় জনপরিসরে যারা ধূমপান করে তাদের জরিমানা করছে। এমনকি যারা কোনো অনুমতি ছাড়া বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বা বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড প্রকাশ্যে লাগাচ্ছে সেগুলোর জন্যও শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
এখন যেহেতু বিষয়টি বাস্তবায়নের পথে সেই জন্য আইনের প্রয়োগটাকে আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি না। এই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যখন ব্যাপকভাবে অভিযান চালাবে জনপরিসরে, তখন দেখা যাবে। জনপরিসর বলতে আমরা যেটা বুঝি এটাও বর্তমান সরকারের সময় আইনটাকে বিস্তৃত করা হয়েছে। যেমন এখন লিফটের মধ্যে কেউ সিগারেট খেতে পারবে না। টয়লেটের মধ্যে কেউ খেতে পারবে না। কতগুলো জায়গা আছে যেমন হাসপাতাল, ক্লিনিক, অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বামি স্টেশন, রেলস্টেশন, স্টিমার স্টেশন, শপিং মল এ রকম বিভিন্ন জায়গাতে এখন একেবারে ধূমপান নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ এটা লিখতে হবে। এখন ধূমপান নিষেধ এ কথাটিও বলা যাবে না। লেখাটা কী হবে সেটাও আবার নিয়ম মেনে লিখতে হবে। আরেকটি বিশেষ কথা হচ্ছে যিনি পাবলিক প্লেসে ধূমপান করবেন তার ৩০০ টাকা জরিমানা তো হবেই আবার যদি কেউ হাসপাতালের মধ্যে ধূমপান করেন তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। কারণ তিনি দেখেননি কেন, এর দায়িত্বটা কেন তিনি নেননি? মানুষ কেন জানে না এখানে ধূমপান করা নিষেধ?
প্রশ্ন : আরেকটি বিষয় হলো পরোক্ষ ধূমপান। যেখানে আরেকজনের ক্ষতি হচ্ছে সে ধূমপান না করলেও। এই জায়গাতে আপনারা কতটুকু সচেতনতা বৃদ্ধি করেছেন?
উত্তর : পাবলিক প্লেসকে ধূমপানমুক্ত রাখার প্রধান কারণটিই হচ্ছে পরোক্ষ ধূমপান। যাঁরা করেন না তাঁদের যেন ক্ষতি না হয়। অর্থাৎ যে নারীটি পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বা একজন অধূমপায়ী ব্যক্তি বা একজন শিশু সে ধূমপায়ীর পাশে আছে, ধোঁয়াটা বাতাসের সঙ্গে মিশে তারও নাক দিয়ে ভেতরে যেতে পারে এবং সমানভাবে তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তখন সেও সমানভাবে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে, সমানভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনপরিসরকে সম্পূর্ণভাবে ধূমপানমুক্ত এলাকা (নো স্মোকিং জোন) করতে বলেছে। কারণ যারা নিরীহ মানুষ, যারা অধূমপায়ী তারা কেন এর শিকার হবে। ধূমপান না করেও তাদের কেন ফুসফুসে ক্যানসার হবে। এটা নিশ্চিত করার জন্যই জনপরিসরকে ধূমপানমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া নারীর মধ্যে যে স্তনের ক্যানসার হয়, সেগুলোর জন্য দায়ীও পরোক্ষ ধূমপান। এগুলো আগে মানুষ জানত না। এখন গবেষণায় সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীতে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবছর তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মৃত্যুবরণ করে। তার মধ্যে ছয় লাখ হলো পরোক্ষ ধূমপানের কারণে। দেখা যাচ্ছে নির্দোষ হলেও তারা বিষয়টির শিকার হচ্ছে। সুতরাং এ জন্যই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটা বিশেষভাবে জরুরি আমাদের মতো দেশে।
বাসস্টেশনে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে, স্টিমারস্টেশনে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে, শপিং মলে ধূমপান করে, হাসপাতাল, ক্লিনিকে ধূমপান করে এগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে পরিণত করার জন্য সরকারি নির্দেশ আছে। সুতরাং কর্তৃপক্ষকে সাইনবোর্ড দিতে হবে। পাশাপাশি তাদের নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে যেন এসব জায়গায় কেউ ধূমপান না করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে ১৮ বছরের বয়সের নিচে যারা, তারা সিগারেট কিনতে পারবে না। সেই আইনটিও এবার সরকার করেছে। তার মানে শিশু-কিশোরের যে এগুলো খাওয়ার প্রবণতা ছিল, সেটাকে বন্ধ করার জন্য এই আইনটি হয়েছে। এবং এখানে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে কাউকে তামাক বিক্রির কাজেও ব্যবহার করা যাবে না। অনেক সময় দেখা যায়, তামাক কোম্পানিগুলো ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে সিগারেট বিক্রি করায়, জর্দা বিক্রি করায় এই জিনিসগুলো ১৮ বছরের নিচে কাউকে দিয়ে করলে সেখানে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সুতরাং এই জিনিসগুলো এখন আইনের মধ্যে আনা হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ছবির মাধ্যমে সতর্কতা (পিক্টোরাল অ্যাওয়ারনেস)। আপনি বিদেশে গেলে দেখবেন প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে ৫০ শতাংশ অংশ থাকে ফুসফুসের ক্যানসারের ছবি। মুখের ক্যানসারের ছবি। এই মুখের ক্যানসারটি হয় তামাকের কারণে। সুতরাং যিনি তামাক গ্রহণ করতে চাইবেন, তিনি প্রতিবার প্যাকেটটি খোলার সময় সেই ছবিটা দেখবেন এবং তাঁর মধ্যে সেই ভীতিটা কাজ করবে। এই যে মানসিক প্রভাবটা, তিনি ছবিটা দেখলে আতঙ্কিত হতে পারেন। তাঁর মধ্যে একটা মানসিক ক্রিয়া হতে পারে এবং তা তিনি ছেড়ে দিতে পারেন। এসব গবেষণার ফসল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব গবেষণা করে দেখা গেছে, ছবির মাধ্যমে সতর্ক করা (পিক্টোরিয়াল ওয়ার্নিং) যখনই প্যাকেটের গায়ে দেওয়া হয়েছে। তখন ধূমপায়ীর সংখ্যা কমেছে। কানাডার মতো দেশে যেখানে ১০০ শতাংশ লোক শিক্ষিত, সেই দেশেও প্যাকেটের গায়ে এ ধরনের ছবি আছে। সিঙ্গাপুরে আছে। অস্ট্রেলিয়াতে তো আরো বেশি কড়া আইন। আগামী বছরের মার্চ মাসে আমরা প্রতিটা সিগারেটের প্যাকেটে পাব এটি দেখতে পাব।
প্রশ্ন : এ ধরনের আইনের জন্য ধন্যবাদ আপনাদের। আলোচনার শেষ পর্যায়ে দর্শকদের উদ্দেশে ছোট্ট করে কিছু বলুন।
উত্তর : দর্শকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, প্রত্যেক পরিবারের কাছে, বাবা-মায়ের কাছে, আপনার সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখুন, তারা যেন কখনো সিগারেট বা ধূমপানের নেশায় নেশাগ্রস্ত না হয়। কারণ এটা এমন একটি বদ-অভ্যাস যার ফলে মানুষের ২৫টি রোগ হতে পারে। দেখা যায়, অনেক সময় সন্তানরা ধূমপান করতে করতে ধীরে ধীরে মাদকের দিকেও ঝুঁকে পড়ে। সুতরাং তাদের এই ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে আপনারা তাদের সচেতন করুন। নিজেরা কথা বলুন এবং তাদের এই শিক্ষা দিন, তারা যেন কখনো বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায় না পড়ে, সিগারেট বা তামাক গ্রহণ না করে।