ক্যানসার প্রতিরোধে কী করবেন?
ক্যানসার একটি আতঙ্কের নাম। তবে সঠিক প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা হলে অনেকটাই সুস্থ হওয়া সম্ভব। আজ ২৯ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৩৫ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার ইপিডিমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
প্রশ্ন : ক্যানসারের প্রধান কারণগুলো কী?
উত্তর : ক্যানসারের ঝুঁকির কারণগুলোকে আমরা কয়েকভাগে ভাগ করতে পারি। সবার আগে বলি আমরা কিছু আছে বংশগত। শতকরা ১০ ভাগের মতো রয়েছে যেগুলো বংশগত। পূর্ববর্তী প্রজন্মের কারো থাকলে এটা পরবর্তী প্রজন্মের কারো কারো মধ্যে হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। যেমন : মহিলাদের স্তন ক্যানসার। যদি কারো নিকটাত্মীয় মায়ের দিককার, মা, খালা, বড় বোন- এ রকম কারো যদি স্তন ক্যানসার হওয়ার ইতিহাস থাকে তাহলে ওই মহিলার স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকবে। আবার বাচ্চাদের চোখের পর্দায় এক ধরনের টিউমার হয় রেটিনোব্লাসস্টোমা এটাও বংশগত কারণে হয়। এক বাচ্চার মধ্যে থাকলে আমরা অন্য বাচ্চার চোখগুলো পরীক্ষা করতে বলি। এ রকম আরো কিছু কারণ আছে। এগুলো শতকরা ১০ ভাগের মতো হতে পারে। বাকি শতকরা ৯০ ভাগের বেলায় পরিবেশ সম্পর্কিত। বোঝার সুবিধার্থে পরিবেশকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। কিছু রয়েছে রাসায়নিক পদার্থ। urgentPhotoরাসায়নিক পদার্থের মধ্যে অনেক নাম আছে। তবে বাংলাদেশের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর্সেনিক। সে ক্ষেত্রে ত্বক বা চামড়ার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। শরীরের আরো কিছু জায়গায় এর প্রভাব আছে। আরেকটি হচ্ছে তামাক, যেটা রাসায়নিক গোডাউন বলা যায়। এর মধ্যে চার হাজার উপাদান আছে যার মধ্যে অন্তত ৪৫টা সরাসরি ক্যানসার সৃষ্টির সাথে জড়িত। সেই তামাক আবার ধূমপান হতে পারে। যেমন : বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা। আবার আরেকটি হতে পারে যেগুলোকে আমরা চিবাই । যেমন : জর্দা, সাদা পাতা, গুল, খৈনি- এগুলোর প্রচলন আছে। এগুলোকে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব। এর বাইরে অ্যালকোহোল বা মদ আছে- যেগুলো তাদের মধ্যে লিভার ক্যানসার, খাদ্যনালি পাকস্থলির ক্যানসার, মুখ গহ্বরের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর মধ্যে কিছু ভৌত পদার্থ বা ভৌত কারণ আছে, যেমন : রেডিয়েশন বা বিকিরণ। এক্সরে খুব প্রয়োজনীয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি বিনা কারণে গিয়ে বারবার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এক্সরে শুরু করে তাহলেও ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সূর্যের আলো যদি সরাসরি শরীরের উপরে অনেক সময় ধরে পড়ে, যেমন, যারা সান বাথ নেয় তাদের মধ্যে চামড়ার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিছু জীবাণু জাতীয় পদার্থের সংক্রমণ যদি দীর্ঘ মেয়াদি হয় পরবর্তীকালে কিছু ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেমন : হেপাটাইটিস জনিত যেই জন্ডিস হয়, বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি, সি- পরবর্তী কালে তার মধ্যে লিভার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আবার একটা ভাইরাসের কথা বলি হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, মহিলাদের জরায়ুর মুখে যে ক্যানসার তার সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ইউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। বাংলাদেশে আবার আরো কিছু কারণ রয়েছে। এ ছাড়া কিছু ব্যাকটেরিয়াও আছে। এর বাইরে যদি আমরা বলি লাইফ স্টালই রিলেটেড মানে আমাদের জীবন আচরণের সাথে যেগুলো সর্ম্পকিত। যেমন খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসের কথা বলি। যারা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত প্রাণীজ আমিষ জাতীয় খাবার খায়- এগুলোতে খাদ্যনালিদের যে শেষের অংশ যাকে কোলোন বলি তার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাহলে ভালো খাবার কী? ভালো খাবার হলো, শাক সবজি ফল মূল বা যেসব খাবারের মধ্যে প্রচুর ফাইবার আছে, সেগুলো ক্যানসার থেকে আমাদের প্রতিরোধ করে। এই গেল খাবার-দাবারের কথা। এর বাইরে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলব। সারা শরীরের পরিচ্ছন্নতা দরকার। মুখ গহ্বরের ক্যানসার সাথে কিছুটা হলেও এর সম্পর্ক আছে। পরিচ্ছন্নতার অভাব হলে এটা হয়। আর জরায়ুর মুখের ক্যানসারের সাথেও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার সম্পর্ক রয়েছে।
এ ছাড়া সামাজিক কিছু বিষয় রয়েছে। মেয়েদের বিয়ের বয়সের সাথে প্রধান দুটো ক্যানসারের সাথে এর সম্পর্ক আছে। আমরা জানি খুবর অল্প বয়সে বিয়ে হলে জরায়ু মুখের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার তাই বলে যদি অনেক দেরিতে মেয়েদের বিয়ের কথা বলি ৩০ অথবা ৩২-এর পর তাহলেও স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে বিয়ে এবং প্রথম বাচ্চা নিতে হবে। এর সাথে শরীরের হরমোন গত কিছু বিষয় আছে। আরেকটি কারণ হলো নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এটা থেকে অনেক বাজে রোগ হতে পারে। এমনকি ক্যানসার ছড়ানোরও ঝুঁকি থাকে। আরেকটি বিষয় হলো কায়িক পরিশ্রম না করা। আবার খাওয়া-দাওয়ার বেলায় খুব চর্বিযুক্ত খাবার খায় , বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে যদি স্থূলাঙ্গিনী হয়ে যায় এতে ঝুঁকি বাড়ে। আর বাচ্চাকে যে বুকের দুধ না খাওয়ায় এর মধ্যে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো মানে সন্তান এবং মায়ের দুজনেরই উপকার করা। এগুলো যদি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে তাহলে ক্যানসার থেকে অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ দূরে থাকা যায়। এতক্ষণ যেগুলো বললাম এগুলো প্রাথমিক স্তরের প্রতিরোধ।
এরপর রয়েছ দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিরোধ। সেগুলো আমরা হয়তো ফেরাতে পারব না। তবে খুব প্রাথমিক অবস্থায় বা সূচনায় যদি ক্যানসারটা ধরা পড়ে তাহলে চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করা সম্ভব, প্রায় ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে । তবে শুরুতে ধরা পড়তে হবে। নিয়মমতো চিকিৎসা করতে হবে। একটু ভালোবোধ করলাম আর বাড়ি চলে গেলাম, এতে হবে না।
ক্যানসারের ভালো চিকিৎসা আছে। সেটি বাংলাদেশে ভালো মতোই করা সম্ভব।
প্রশ্ন : প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসার জন্য জ্ঞানটা তাকে দিতে হবে...
উত্তর : সেটার জন্য আমরা বলি ক্যানসারের সাতটি বিপদ সংকেত আছে। এই বিপদ সংকেত এক বা একাধিক দেখা দিলে আতঙ্কিত হবেন না। তবে সচেতন হবেন। দুই সপ্তাহ স্বাভাবিক চিকিৎসা নেবেন এর পর যদি উপকার না পান তবে চিকিৎসকের কাছে যাবেন। যেমন : খুসখুসে কাশি বা ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর, গলা বসে যাওয়া, ভাঙ্গা গলা যদি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় একটু সতর্ক হবেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। এতে ফুসফুস বা ভয়েস বক্সের ক্যানসার হতে পারে।
যদি স্তনে বা শরীরের কোথাও কোনো চাকা বা পিণ্ড দেখা যায় তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। তারপর যদি দেখি অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে শরীরের যেকোনো রাস্তা দিয়ে তখনো সতর্ক হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
যদি কোনো ঘা সহজে না শুকায়, ডায়াবেটিস হলেও কিন্তু ঘা শুকায় না। যদি কারো ডায়াবেটিসও নাই, আবার ঘা শুকাচ্ছে না। অবশ্যই সতর্ক হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
কারো যদি ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়। আগে অসুবিধা ছিল না এখন শক্ত খাবার খেতে অসুবিধা হয়, এক গ্লাস পানি হয়তো গিলতে পারছে না। খাদ্যনালির ক্যানসারের লক্ষণটা এ রকম।
এ ছাড়া তিল বা আঁচিলের যদি কোনো সুস্পষ্ট পরিবর্তন হয়। হঠাৎ বড় হয়ে যায়, রং পরিবর্তন হয় , ভেতর থেকে রক্ত বা কষ বের হয় তখন এ রকম হতে পারে। এ রকম বিপদ সংকেতগুলোতে একটু সতর্ক হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধরা পড়লে চিকিৎসায় ভালো হওয়া সম্ভব।