প্লাস্টিক সার্জারি কেন করা হয়?

দেহের সৌন্দর্যবর্ধন বা জন্মগতত্রুটি সারানোসহ নানা কারণেই প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৫২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. শহীদুল বারী।
প্রশ্ন : প্লাস্টিক সার্জারি বিষয়টি কী এবং এর প্রধান ব্যবহারগুলো কী?
উত্তর : প্লাস্টিক সার্জারি একটি শল্য চিকিৎসা। প্লাস্টিক কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ প্লাস্টিকস থেকে। এর মানে হলো পরিবর্তন করা। একটা জিনিস যেটা শরীরে আছে, সেটা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় ব্যবহার করা। প্লাস্টিক সার্জারির দুটি শাখা। একটি হলো এসথেটিক, আরেকটি হলো রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি। যখন শুরু হয়েছিল প্লাস্টিক সার্জারি, তখন কেবল রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি ছিল। যেমন : জন্মগত ত্রুটি। অর্থাৎ জন্মগতভাবে তার একটা অংশ নেই। হয়তো তালু কাটা বা ঠোঁট কাটা। অথবা তার নাকের একটি অংশ জন্মগতভাবে নেই। এটাকে পুনর্গঠন করা হয়। অথবা একটা সড়ক দুর্ঘটনা হলো, শরীরের একটা অংশ নষ্ট হয়ে গেল, মাংস বা নরম টিস্যু নষ্ট হয়ে গেল, আবার হয়তো একটা টিউমার হলো, একটা অংশ কেটে ফেলে দিয়েছে- এই যে খালি অংশটা থাকল সেখানে – এসব জায়গাগুলো পুনর্গঠন করার যে প্রক্রিয়া এগুলোকে বলা হয় রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি।urgentPhoto
আর আরেকটা শাখা হলো এসথেটিক সার্জারি। যাকে সাধারণ মানুষ বলে কসমেটিক সার্জারি। কিছু সমস্যা রয়েছে যেমন নাকটা একটু থেবড়া, নাকের ওপরের অংশ একটু উঁচু হয়ে আছে, অথবা নাকের মাথাটা একটু মোটা। অথবা ঠোঁট মোটা, মুখ ব্রণের দাগে ভর্তি হয়ে আছে বা পেটটা ফুলে আছে। শুধুমাত্র সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এই সার্জারি করা হয়। এটাকে আমরা বলি এসথেটিক সার্জারি বা কসমেটিক সার্জারি।
প্রশ্ন : কোন কোন রোগীরা আপনাদের কাছে আসে যেটিতে আপনারা প্লাস্টিক সার্জারিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?
উত্তর : বাংলাদেশে আমরা বেশি রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি রোগী পাই। হয়তো আগুনে পুড়ে বিকলাঙ্গ হয়ে আসে। এসব রোগী আমরা বেশি পাই। এ ছাড়া জন্মগত ত্রুটি নিয়ে রোগী আসে। যেমন : ঠোঁটকাটা এবং তালু কাটা। আমি ১১ হাজার ঠোঁট কাটা এবং তালু কাটার রোগী অস্ত্রোপচার করেছি।
এরপরে কিছু সড়ক দুর্ঘটনার রোগী পাই, ব্যক্তির হয়তো শরীরের কোনো অংশের মাংস চলে গেছে এমন। আরেকটি যেটা পাই বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে সেটা হলো ব্রণের দাগ। ব্রণের দাগ আমাদের কাছে তুলতে আসে। আর নাকের সৌন্দর্য বাড়াতে আসে। আরেকটি আমরা এখন পাচ্ছি টাক মাথায় চুল গজানো। এটা বেশ প্রচলিত। আরেক ধরনের রোগী পাই, পেটের অতিরিক্ত চর্বি কমানো- এই ধরনের রোগীও আমরা পাচ্ছি।
প্রশ্ন : কসমেটিক সার্জারি বা সৌন্দর্যবর্ধনের সার্জারি করার আগে রোগী নির্ধারণ করার জন্য আপনারা কোনো নিয়ম মানেন কি না?
উত্তর : আসলে মানুষের আশা অনেক উচ্চ থাকে। মানুষের ধারণা, এই সার্জারির মাধ্যমে একদম চেহারা অন্যরকম করে দেওয়া যায়। একবার আমার কাছে একজন রোগী এসেছে ভারতীয় নায়িকা শ্রীদেবীর ছবি নিয়ে। সে এসে আমাকে বলছে তাঁর নাকের মতো রোগীটির নাক করে দিতে হবে।
আবার কিছু কিছু মানুষ দেখা যায় কোনো ছবি নিয়ে আসে, বলে তার সবকিছু পরিবর্তন করে ছবির মতো করে দেওয়া যাবে কি না। আবার হয়তো ৮০ বছরের বৃদ্ধ তাঁকে ২৫ বছরের তরুণ যুবকের মতো করে দিতে বলে। এটা আসলে কখনোই সম্ভব নয়। কারণ সবকিছুর একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের ক্ষমতার একটি পর্যায় রয়েছে, যার বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না।
প্রশ্ন : একটি জিনিস মানানসই হওয়ারও বিষয় আছে। কারণ শ্রীদেবীর নাক তাঁর সঙ্গে যে রকম মানানসই, সেটি আরেকজনের ক্ষেত্রে নাও হতে পারে.....
উত্তর : এটা হচ্ছে আসল কথা। সব কিছুর মধ্যে একটা মানানসই বিষয় থাকতে হয়। প্রথমে জানতে হবে তাঁর চাহিদা কতটুকু। এরপর তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে বলি তাঁর সঙ্গে কী মানাবে। মুখের গঠন অনুসারে আমরা অনেকখানি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসি। কিন্তু পুরোপুরি চেহারা পরিবর্তন করে দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : পেটের মেদ সার্জারি করে কমানোর পর আপনাদের পরামর্শ কী থাকে, যাতে এটা মেনে চলা যায়?
উত্তর : প্রথমে আমি কারণটা বলতে চাই। আমাদের দেশের মানুষ বিশেষ করে ঢাকায়, ঘর থেকে বের হয়েই রিকশায় ওঠে। রিকশায় চড়ে গন্তব্যস্থলে যাচ্ছে। অথবা বাসে চড়ছে। আমাদের দেশের মানুষের হাঁটার অভ্যাস একদম নেই। আবার টেবিল চেয়ারে বসে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করছে। সঙ্গে আবার বসে বসে ফাস্টফুড খাচ্ছে। বার্গার, স্যান্ডউইচ, চিকেন ফ্রাই-সবই রিচফুড খাচ্ছে। তাই যে পরিমাণ ক্যালরি সে গ্রহণ করছে, সে পরিমাণ পুড়ছে না। হাঁটাচলা একদমই হয় না। বাসায় গেলাম, খাওয়াদাওয়া করলাম, বিশ্রাম নিলাম, ঘুমালাম। এ কারণে শরীরে ক্যালরি না পুড়ে শরীরে চর্বি আকারে জমে যাচ্ছে।
আমরা তাদের পরামর্শ দিই কী পদ্ধতিতে এটি কমাবেন। দুটো পদ্ধতি রয়েছে এর। একটি হলো লাইপোসেকশন, আরেকটি হলো এবডোমিনো প্লাস্টি।
যাদের বিভিন্ন জায়গায় চর্বি জমেছে তবে ত্বক এখনো শক্ত বা টাইট তাদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত হচ্ছে লাইপোস্যাকশন। কারণ চর্বিটা বের করে দিলে ত্বকটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় অতিরিক্ত চর্বি জমেছে, আবার পেটটা ঝুলে নিচের দিকে জমে গেছে। সেখান থেকে চর্বি বের করলে আরো ঝুলে যাবে। সে সমস্ত ক্ষেত্রে চামড়াও ফেলতে হবে। চর্বিও ফেলতে হবে। সেই ক্ষেত্রে লাইপোসেকশন কার্যকরী নয়। সে ক্ষেত্রে এবডোমিনো প্লাস্টি বা টামিটেক সার্জারি বলে।
প্রশ্ন : সার্জারি করার পর পরবর্তীকালে মেনটেইন করার পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : আমাদের প্রথম পরামর্শ হচ্ছে ব্যায়াম। তাঁকে ৪৫ মিনিট হাঁটতে হবে। সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন। দ্বিতীয়টি আমরা বলি, জাংকফুড-জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে। এগুলো বাদ দিয়ে শাকসবজি এবং দেশি ফল খাবে। একটা ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস তাকে মেনে চলতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি যে পরামর্শ দিলেন, সেটা যদি ব্যক্তি প্রথম থেকেই পালন করে তাহলে হয়তো সার্জারির দিকে আর আসতেই হয় না। আমরা আশা করব মানুষ বিষয়টি বুঝবে...
উত্তর : এটা আপনি ঠিক কথাই বলেছেন, আমরা রোগীদের বলি এই ধরনের সার্জারি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের বিকল্প নয়। অস্ত্রোপচারের আগে আমরা রোগীদের বলি ডায়েট করেন, ব্যায়াম করেন, দেখেন কতটুকু কমে। এরপর কিছু বাকি থাকলে আমরা সার্জারি করে দেব।