ত্বকের রোগ সোরিয়াসিস কি ছোঁয়াচে?

ত্বকের একটি জটিল রোগ সোরিয়াসিল। এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কম, তবে ভোগান্তি বেশি। আজ ১৯ ডিসেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৪০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং হলিফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবীর চৌধুরী।
প্রশ্ন : সোরিয়াসিস রোগটি মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। ত্বকের সোরিয়াসিস রোগটি আসলে কী?
উত্তর : পৃথিবীতে এখন সোরিয়াসিস রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমি যে চর্মরোগী দেখি তার মধ্যে দেখা যায় যে, সোরিয়াসিস রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই রোগকে আগে এক্সিমা বলে ধরা হতো। তাই সোরিয়াসিস নামটি অপরিচিত। তবে এখন সোরিয়াসিস বলা হয়। এখন যে সোরিয়াসিস ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এটার কানাডায় হেড কোয়ার্টার, এখানে তালিকাভুক্ত সোরিয়াসিসের রোগী সংখ্যা ২০ কোটি। বাংলাদেশ এই তালিকার মধ্যে নেই। কারণ আমাদের দেশে কোনো জাতীয় পর্যায়ের ডাটা তৈরি হয়নি।
সোরিয়াসিস রোগে শরীরের হাঁটুতে, কনুইতে এক ধরনের আঁশের মতো দেখা যায়। এক ধরনের রুপালি আঁশ বা মাছের আঁশের মতো দেখা যায়। যখনই আঁশ উঠে হাল্কা একটু রক্তক্ষরণ হয়। এটাতে তেমন কোনো চুলকানি হয় না। তেমন কোনো ব্যথা হয় না। সেজন্য উপসর্গ কম থাকে বলে অনেকে একে গুরুত্ব দেয় না।
প্রশ্ন : সোরিয়াসিস রোগটি হওয়ার পেছনে কোনো কারণ রয়েছে কী?
উত্তর : সোরিয়াসিরের কারণ এখনো তেমনভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে এক নম্বর কারণ হলো, জেনেটিক। পরিবারের কারো থাকলে এটি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। দ্বিতীয় হলো, পরিবেশ- শুষ্ক পরিবেশ, দূষণযুক্ত পরিবেশ। আমাদের দেশে পরিবেশ দূষণ বেশি, কার্বণ বেশি। এই কারণে সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া ভেজাল খাওয়া-দাওয়া থেকেও এটা হতে পারে।urgentPhoto
আর খাওয়ার মধ্যে বলা হয় দুটো এসিড যেমন, এসিটিক এসিড বা সাইট্রিক এসিড থাকে, বিশেষ করে লেবুতে- এটা থেকে সোরিয়াসিস বাড়ে। আর দেখা যাচ্ছে যে গরুর মাংস বা রেড মিট থেকে এটি বাড়ে। আর দেখা যায়, কিছু ওষুধ, যেমন বিটা ব্লকার জাতীয় ওষুধ খেলে, এগুলো বাড়ে। অনেকের হয়তো সোরিয়াসিস হওয়ার আশঙ্কা ছিল না, তবে এধরনের ওষুধ খাওয়ার কারণে হয়ে যাচ্ছে। কারণ একটি মানুষ জন্মগতভাবে হয়তো কয়েকটি রোগ হওয়ার প্রবণতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। সে রোগ তার হয় না, যদি ওই পরিবেশ তৈরি না হয়। হয়তো তার জিনের মধ্যে আছে, তবে প্রকাশ পাওয়ার জন্য কিছু কারণ কাজ করে। এই কারণের মধ্যে দুশ্চিন্তা আছে, মানসিক চাপও রয়েছে।
প্রশ্ন : সোরিয়াসিস কি ছোঁয়াচে?
উত্তর : যদি কারো ইমিউনিটি ( রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) কমে যায়, তখন এর জন্য সোরিয়াসিস হয়। তার হয়তো আগে থেকেই রোগটি জিনের ভেতর রয়েছে, তবে রোগ আগে প্রকাশ পায়নি। কিন্তু এই ইমিউনিটি কমে যাওয়ার জন্য রোগটি প্রকাশ পায়। আর এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এ রকম বহু দম্পতি রয়েছে, যাদের একজনের সোরিয়াসিস রয়েছে, আর একজনের নেই। এখানে দেখা যাচ্ছে কেউ সংক্রমিত হয় না। আজ পর্যন্ত এটি সংক্রমক রোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে যখন রোগী যায়, কী ধরনের চিকিৎসা দেন এবং রোগীকে আশ্বস্ত করেন কী বলে?
উত্তর : প্রথমে বলি, এটি ছোয়াঁচে রোগ নয়। আপনি চিন্তা করবেন না। চিকিৎসা দিয়ে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এমন রোগীও আছে ৩০ বছর ধরে বিনা চিকিৎসায় ভালো আছেন। ভালো হওয়ার পর একে অনেকে তুলনা করেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো আজীবন ওষুধ খাওয়া রোগগুলোর সঙ্গে। তবে সোরিয়াসিসের অনেক রোগী রয়েছেন যাঁরা আজীবন ওষুধ খান না। এক বছর দুই বছর খাওয়ার পর ভালো হয়ে যান। সোরিয়াসিস যদি অল্প মাত্রায় হয়, তখন আমরা স্টেরয়েড ক্রিম ব্যবহার করি। শীতকালে ওয়েনমেন্ট ব্যবহার করি, এটি তৈলাক্ত জিনিস। আর গরমের দিনে ক্রিম ব্যবহার করি। এর মধ্যে স্টেরয়েডটা বেশি ব্যবহার হয়। স্টেরয়েড ছাড়া ভিটামিন ডি থ্রি ব্যবহার করা হয়, রওকেটিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ভ্যাসলিন ব্যবহার করে অনেকে সোরিয়াসিসে ভালো থাকেন। একটু বেশি হলে ভালো অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে অনেকে ভালো থাকেন। আর যদি অনেক বেশি হয়, তখন তার রক্ত পরীক্ষা করে লিভার, কিডনি যদি ভালো থাকে তাহলে ম্যাথোট্রেক্সিন নামের একটি ওষুধ রয়েছে, যেটা ক্যানসারের জন্য ব্যবহার হয়। অনেকে বলেন, এটি তো ক্যানসারের ওষুধ, তাহলে কেন ব্যবহার করেন? আসলে সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে এই ওষুধটি ভালো কাজ করে। যে ডোজ দেওয়া হয় ক্যানসারে এখানে সেটা দেয় না। ভয়ের কিছু নেই, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
প্রশ্ন : কেউ একজন যখন রোগীটি নিয়ে আসে তখন সমস্যাগুলো কী বলে?
উত্তর : প্রথম এসে বলে, মাথায় খুশকি এবং খুশকি থেকে রক্ত আসে। এটি ছোপ ছোপ আকৃতির হয়। তখন আমরা দেখি যে এটি খুশকি নয়, এটি সোরিয়াসিস। অনেকে রয়েছে যাদের নখের মধ্যে কেমন যেন দানা দানা বা গর্ত দেখা যায়, তখন আমরা চিন্তা করি সোরিয়াসিস থাকতে পারে। অনেকে বলে আমার হাঁটুতে কেমন যেন উঁচু একটি বিষয় দেখা যায় বা আমি কনুইতে ভর করে কাজ করি, তখন সমস্যা হয়। এখানে সমস্যা দেখা যায়।
প্রশ্ন : রোগ নির্ণয়ের জন্য কি কেবল ক্লিনিক্যাল ডায়গোনোসিস করেন, না কি আরো কোনো পরীক্ষা করেন?
উত্তর : আসলে রোগী আসার পর স্কিন বায়োপসি করে রোগ নির্ণয় করার চেষ্টা করি। এতে একেবারে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে কারো কারো এর সাথে আনুষঙ্গিক রোগগুলো বাড়তে পারে। এগুলো আমরা রক্ত পরীক্ষা করে দেখি।
আরেকটি জিনিস আমরা দেখি, স্থূলকায় মানুষ যারা, তাদের এই রোগ হয়। অর্থাৎ ওবিসিটির সঙ্গে সোরিয়াসিসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণা করেও এটির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন : যাদের ডায়াবেটিস বা হাইপার টেনশন রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে যদি সোরিয়াসিসযুক্ত হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা হয় কি?
উত্তর : রোগের ভূমিকা তেমন কিছু নেই। তবে ওষুধের বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। যেমন বিটা ব্লকার যদি কেউ খান, বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের জন্য। তখন এটা বাড়তে পারে। আর যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, সোরিয়াসিস বাড়তে পারে। এটি হলো সম্পর্ক। এ দুটো রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটি একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। একটি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে আরেকটি বাড়তে পারে। সোরিয়াসিসের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা বায়োলোজিক্স। বায়োলোজিক্স এমন একটি বিষয় যাকে অ্যান্টিইনফ্লামেটোরি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আরেকটি নতুন ওষুধ সারা বিশ্বে এসেছে। এটি আমাদের দেশে আসতে পারে। এটি অনেক ব্যয়বহুল ইনজেকশন এবং অনেক ফলপ্রসূ চিকিৎসা।
প্রশ্ন : যদি সঠিক চিকিৎসা না করা হয় এবং কিছুদ্নি চিকিৎসা করার পর ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে কী কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?
উত্তর : যদি কেউ চিকিৎসা করার পর ছেড়ে দেন, তখন রোগটি বেড়ে যায়। মেথোট্রেক্সিন, স্টেরয়েড খেয়ে ছেড়ে দেন, তখন রোগটি বেড়ে যায়। হঠাৎ ওষুধ ছাড়লে রোগটি অনেক বেড়ে যায়। আমি বলি সবসময় চিকিৎসকের সাথে দেখা করবেন। নিজে নিজে ওষুধ বন্ধ করবেন না। চালুও করবেন না। চালু রাখলে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে এবং বন্ধ করলে রোগটি বেড়ে যাবে। সেই জন্য সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী থাকবেন।
প্রশ্ন : এই রোগে কি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে?
উত্তর : এই রোগে গিট ব্যথা বা জয়েন্ট পেইন হতে পারে। আর এই রোগে সাধারণত রোগী মারা যায় না। তবে যদি সারা গায়ে সোরিয়াসিস হয়, তাহলে তাপমাত্রার কমবেশি হয়ে, রোগী মারা যেতে পারে। বা সারা গায়ে পুঁজ হয়ে সমস্যা হতে পারে। এই রোগে আসলে ভোগান্তি বেশি, তবে মৃত্যুর ঝুঁকি নগণ্য।