দেখতে সমস্যা, বুঝবেন যেভাবে

চোখের প্রচলিত সমস্যাগুলোর মধ্যে রিফ্লেকটিভ ইরোর বা পাওয়ারজনিত সমস্যা একটি। সময়মতো চিকিৎসা নিলে এই সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩৭৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. জালাল আহম্মেদ। তিনি চক্ষু চিকিৎসাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রশ্ন : চোখের পাওয়ারের সমস্যা আসলে কী?
উত্তর : রিফ্লেকটিভ ইরোর, পাওয়ারজনিত সমস্যা বা দৃষ্টিহীনতা। দৃষ্টিহীনতা ও অন্ধত্বের অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দৃষ্টিহীনতার দ্বিতীয় কারণ হলো রিফ্লেকটিভ ইরোর বা পাওয়ারজনিত সমস্যা। ভালো চোখে চিকিৎসা দেওয়ার পরও যাদের দৃষ্টি ৬/১৮-এর কম, তাদের বলি, ক্ষীণ দৃষ্টি বা দৃষ্টিহীন। সারা বিশ্বে কম দৃষ্টির কারণের মধ্যে রিফ্লেকটিভ ইরোর খুব প্রচলিত। রিফ্লেকটিভ ইরোর অনেকগুলো আছে।
এর মধ্যে একটি হলো মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি। আরেকটি হলো হাইপারমেট্রোপিয়া বা দূরদৃষ্টি। আরেকটি হলো এসটিগমেটিজম।
প্রশ্ন : এই সমস্যাগুলো কোনটি কখন শুরু হয়?urgentPhoto
উত্তর : পাঁচ বছরের আগে জিনিসগুলো জানতে পারলে ভালো হয়। যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়, তাহলে রোগ দ্রুত সারে। ছোট বয়স থেকেই সমস্যাগুলো হতে পারে। এর চিকিৎসা কিন্তু খুব সহজ। আমাদের সমাজে অসুবিধা হলো এটি অনেকে জানতে পারে না। মা-বাবাও এ বিষয়ে সতর্ক থাকে না। পাঁচ বছর থেকে ১৫ বছর বয়সে সবচেয়ে বেশি এ রকম হয়। এর প্রভাবও বেশি।
যেমন ধরেন, একটি বাচ্চা চোখে কম দেখে, এটি বুঝতে পারবে কী করে? প্রথম দায়িত্ব হলো মা-বাবার। এরপর হলো বাচ্চা যখন স্কুলে যায়, স্কুলের শিক্ষকদের। এখন তো সব এলাকাতেই টেলিভিশন আছে, প্রায় সব ঘরেই। দেখা যায়, টেলিভিশন দেখতে গেলে বাচ্চা, টেলিভিশনের কাছে গিয়ে দেখে।
স্কুলে গিয়ে শিক্ষক খেয়াল করে অন্য বাচ্চারা যেমন বোর্ডের লেখা পরিষ্কার লিখতে পারে, এই বাচ্চাগুলো পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, না জানার কারণে অভিভাবকরা বাচ্চাকে ধমকাতে থাকে। বাবা মা মনে করে টেলিভিশনের কাছে গিয়ে দেখার কারণে এ ধরনের সমস্যা হয়। আসলে সেটি নয়। বেশির ভাগ সময় যেটি হয়, অনেকেরই এটি পরিবারে থাকে, যেমন হয়তো ভাইবোনের আছে, মা-বাবার আছে, তাদের এটি বেশি হয়। এ ছাড়াও হতে পারে। তবে বংশগত কারণগুলো একটি বড় কারণ, মায়োপিয়ার ক্ষেত্রে।
আমি তিনটি বলেছি, মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি, এর কাছের জিনিস দেখতে পায়, তবে দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে পোস্টার ভালোভাবে পড়তে পারে না। স্কুলে গিয়ে দেখে পাশের বাচ্চাটা বোর্ডের সব লিখতে পারে, সে পারে না। টেলিভিশনে কোনো মজার অনুষ্ঠান হলে দেখা যাচ্ছে, সে একেবারে কাছে চলে যাচ্ছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে না। এ জন্য সে কাছে গিয়ে দেখে। এটা এক ধরনের মায়োপিয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুনিয়াব্যাপী প্রায় ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মায়োপিয়া দিয়ে। এর প্রভাব অনেক ব্যাপক। ভালো দেখতে না পেলে সে ভালো লেখাপড়া করতে পারে না। ভালো লেখাপড়া না করতে পারলে সে ভালো চাকরি পায় না।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, যাদের দুই চোখের পাওয়ারের ভিন্নতা থাকে, অথবা দুই চোখেই পাওয়ারের সমস্যা থাকে, ছোটবেলায় সাধারণত আমাদের ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ভালো দৃষ্টি তৈরি হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি ভালোভাবে ঠিক করা না যায়, দুটো চোখের মধ্যে একটি চোখ অলস থাকে, এই অলস চোখ যদি কারো হয়ে যায়, এর চিকিৎসা যদি শিশু বয়সে না করা যায়, বড় হলে ওই চোখের স্থায়ী দৃষ্টিহীনতা চলে আসে। স্থায়ী দৃষ্টিহীনতা হলে তার লেখা পড়া, ভবিষ্যৎ জীবনে চাকরি- সব কিছুতেই সমস্যা দেখা যায়। এটা সামাজিক সমস্যাও বটে। একজন মানুষ যদি ভালো দেখতে না পায়, সে ভালো কাজ করতে পারে না। লেখাপড়াও করতে পারে না। সমাজে সহযোগিতা করতে পারে না। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নও কম হয়। আরো আছে হাইপার মেট্রোপিয়া। এরা দূরে দেখতে পায়, তবে কাছে অসুবিধা হয়। আবার কারো কারো দূরে কাছে দুটোতেই অসুবিধা হয়। এগুলোও ছোট বয়সে হয়।
পাঁচ বছরের আগে রোগ নির্ণয় করতে পারলে ভালো। আর এমব্লায়োপিয়া যেটি বললাম, অলস চোখ, এটি কিন্তু হাইপারমেট্রোপিক বাচ্চাদের মধ্যে অনেক বেশি। আরেক দল আছে, যাদের সিলিন্ডিক্যাল পাওয়ার লাগে, তাদের অনেক সময় মাথাব্যথা হয়। চোখে ব্যথা হয়, মাথাব্যথা হয়, তারা লেখাপড়ায় ভালো করতে পারে না। সব সময় তাদের একটি অস্বস্তি থাকে। তাই খুব শুরু থেকে সচেতন হতে হবে।
বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করার আগে প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত হবে, তার দৃষ্টি সঠিক আছে কি না এর পরীক্ষা করা। অনেক দেশে এটা বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলকভাবে বাচ্চার দৃষ্টি পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটা এখনো চালু নেই। তাই প্রত্যেক মা বাবাকে সতর্ক হতে হবে, দেখতে হবে, তার বাচ্চার দৃষ্টি সঠিক আছে কি না।
চিকিৎসাটা খুব সহজ। সবচেয়ে সহজে যেটা করা যায়, দৃষ্টি পরীক্ষা করানো। কাছের হাসপাতাল বা চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে দৃষ্টি পরীক্ষা করা। এ ছাড়া বাবা-মা বাসাতেই পরীক্ষা করতে পারেন।
সামনের দেয়ালে কোনো ছবি রেখে কিংবা এখন ভিশন চার্ট পাওয়া যায় সেগুলো রেখে, হাতের তালু দিয়ে এক চোখ ঢেকে শিশুকে পড়তে বলা। আবার আরেক চোখ দিয়ে পড়তে বলা। এতে যদি সে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পড়তে পারে, তাহলেই তাকে বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে।
আরেকটি পরীক্ষা আছে, ছোট একটি কার্ড যদি আমরা নিই, এই কার্ডের মাঝখানে যদি একটি ছোট্ট ছিদ্র করি, যে চোখে দেখতে পায় না, সেই চোখের সামনে যদি আমি কার্ড ধরি- সাধারণত ছিদ্র দিয়ে এমনি খালি চোখে দেখতে পাই না- তবে ছিদ্রের ভেতর দিয়ে যদি এখন দেখতে পাই তবে সমস্যা আছে।
এটি ঠিক করার পদ্ধতি আছে, একটি হলো চশমা দিয়ে ঠিক করা, এ ছাড়া আরো পদ্ধতি আছে। দৃষ্টির সমস্যাকে সময়মতো নির্ণয় করতে হবে এবং চিকিৎসা করতে হবে। সহজ চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে আসতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের কর্মক্ষমতা বাড়বে।