কণ্ঠস্বরের যত্নে

ভয়েস বা কণ্ঠস্বর দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়মিত এর পরিচর্যা জরুরি। সমস্যা যাতে না হয়, তার প্রতিরোধের জন্যও কাজ করা দরকার। আজ ৩০ এপ্রিল এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০২১তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক, কান, গলা রোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান তরফদার।
প্রশ্ন : শুরুতে যদি একটু বলেন কণ্ঠস্বরের সমস্যা নাক, কান, গলার সঙ্গে সম্পর্কিত কেন?
উত্তর : যাঁরা কণ্ঠস্বর ব্যবহারকারী বিশেষত শিক্ষক, হকার, রাজনীতিবিদ, ছাত্র, যাঁরা গান করেন, অভিনয় করেন; যাঁদের এই কণ্ঠের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাঁদের জন্য কণ্ঠস্বর সুন্দর হওয়া, বাচনভঙ্গি সুন্দর হওয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।
দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক লোক তিনি মেয়েলি স্বরে বা বাচ্চাদের স্বরে কথা বলছেন। অথবা খুব ভালো করে কথা বলছিলেন, কিছুদিন ধরে স্বর পরিবর্তন হচ্ছে। অথবা মাস তিনেক ধরে তাঁর আওয়াজই বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি হলো স্বর চলছে কিন্তু মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে। এসব সমস্যায় কণ্ঠের যত্ন নেওয়া জরুরি। কণ্ঠের সমস্যা অনেক সময় গলা থেকে হয়। তাই এটি নাক, কান, গলা সম্পর্কিত একটি সমস্যা।urgentPhoto
প্রশ্ন : আমরা জানি, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে বা মেয়ের স্বরের পরিবর্তন হয়। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। স্বরের পরিবর্তন কোন বয়সে হয়? এবং কোন বয়সে এই পরিবর্তন না হলে এটার অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে?
উত্তর : আগে আমরা বলতাম বয়ঃসন্ধিকালে স্বরের পরিবর্তন হয়। আমরা এখন বলি, এটা নয়। এই স্বরের পরিবর্তন প্রথম থেকেই হয়। ছোটবেলা থেকেই। ছোটাবেলা থেকে স্বরাঘাত ঠিকমতো না হলে ভবিষতে সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : প্রথম থেকে মানে কী? কোন বয়স থেকে?
উত্তর : যেদিন থেকে শিশু কথা বলতে শিখবে তখন থেকে। অ, আ, ক, খ অথবা এ, বি, সি, ডি -এগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করা শিখলে স্বরাঘাত সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
তারপরে যদি স্বরের অপব্যবহার হয়, তখনো কণ্ঠস্বরের সমস্যা হয়। বাচ্চা যদি বেশি চিৎকার করে, তখন সমস্যা হতে পারে। ডাব্লিউএইচওর মতে, একজন একসাথে ২০ মিনিটের বেশি কথা বলবেন না।
শ্রেণিকক্ষে শেখাটা যদি অডিওভিজুয়ালের মাধ্যমে করা যায় তবে কণ্ঠস্বরের ওপর চাপ কম পড়ে। শেখা, জানা, পড়াটা সুন্দর হয়। বলার থেকে দেখায় শিক্ষা গ্রহণ বেশি করা যায়। এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় এখন অডিওভিজুয়াল মিডিয়া ব্যবহার করা হয়। স্বরের সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত।
প্রশ্ন : আপনি যদি একটু প্রাপ্তবয়স্কদের বেলায় বলেন?
উত্তর : প্রাপ্তবয়স্কদের বেলায় আমরা দেখি যাঁরা গান করেন বা শিক্ষক, কিছু বিষয় আপনাকে পরিবর্তন করতে হবে। যেমন, আপনাকে জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন করতে হবে। অতিরিক্ত জোরে চিৎকার করা যাবে না। ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। মদ্যপান পরিহার করবেন। ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
খাওয়ার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ, যেমন রাতের বেলা ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার না খাওয়া ভালো। অথবা খেলেও ঘুমের অন্তত তিন ঘণ্টা আগে খেতে হবে। আমরা যেন খাওয়ার সাথে সাথে বিছানায় না যাই। তখন পেটে এসিডিটি হয়ে গলায় সমস্যা তৈরি করে। এসিডও ফ্যারিংজাইটিস, ল্যারিংজাইটিস এসব সমস্যার অন্যতম কারণ। আপনি হয়তো খাওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন, এই এসিড এসে গলায় আক্রমণ করল এবং ভোকাল কর্ড সংক্রমিত করে কণ্ঠস্বর বদলে দিল। তাই ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। খাওয়ার সময় কফি, চা, ধূমপান এগুলো এড়িয়ে যাবেন। এগুলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে। যদি আপনার কণ্ঠস্বর এবং ঘুম দুটোরই যত্ন নিতে চান তবে এগুলো মেনে চলতে হবে। স্লিপ হাইজিন হতে হবে।
প্রশ্ন : স্লিপ হাইজিন বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কতক্ষণ ঘুমানো উচিত?
উত্তর : আট ঘণ্টা ঘুমাতে পারলে খুবই ভালো। ছয় ঘণ্টাতে চলে। প্রতিদিন একটি নির্ধারিত সময়ে ঘুমাতে যাবেন। শোবার ঘরের পর্দায় উত্তেজক রং ব্যবহার না করা ভালো। যেমন লাল, নীল ইত্যাদি। থাকতে হবে সাদা অথবা সবুজ। শোবার ঘরে টিভি, কম্পিউটার এগুলো না থাকাই ভালো।
পানির বিষয়ে বলি, প্রতিদিন একজন সুস্থ মানুষের অন্তত আট গ্লাস পানি খাওয়া উচিত। এটি ভোকাল কর্ডের জন্য ভালো। স্লিপ হাইজিন বলতে বোঝানো হয় ভালো ঘুম (পরিমাণগত ও গুণগত) এবং পাশাপাশি ভোকাল কর্ডের অন্যান্য যত্ন নেওয়া।
প্রশ্ন : এসব কিছু মানার পরেও যদি হঠাৎ করে কণ্ঠস্বর ভেঙে যায় তাহলে কী করণীয়?
উত্তর : এ রকম হতে পারে। হঠাৎ করে হয়তো ঠান্ডা লেগেছে, আবহাওয়ার পরিবর্তনে এ রকম হয়ে গেছে। ভোকাল কর্ড তো একধরনের পাতলা তার। আপনি কথা বলছেন মানে সে কাঁপছে। ফুসফুস থেকে যে বাতাস আসে এর মাধ্যমে এটা তৈরি হয়। যদি আপনি এর অপব্যবহার করেন ওখানে অ্যাডোমা হয়, রক্তপাত হয়, নডিউল, পলিপ, পেপিলোমা হয়, ট্রমা এবং আলসারেশন হয়। আলসারেশন যদি নিয়মিত থাকে, তাহলে এ থেকে ক্যানসারও হয়।
এখন যদি নডিউল শিক্ষকদের হয়, এখানে স্পিচ থেরাপি জরুরি। ওখানে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে কতটুকু জোরে কথা বলবেন, কত সময় ধরে কথা বলবেন।
প্রশ্ন : হঠাৎ করে এ রকম হলে কণ্ঠস্বরকে বিশ্রাম দেওয়া কতটা জরুরি?
উত্তর : সারাক্ষণ তো কথা বলা যাবে না। আস্তেও কথা বলবেন না, জোরেও কথা বলবেন না। ঠান্ডা কোমল পানীয় এড়িয়ে যেতে হবে। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে সার্জারি করতে হবে। আর তাৎক্ষণিকভাবে আমরা স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকি।