বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে করণীয়
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হচ্ছে। তবে এই মান আরো বাড়াতে করণীয় বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মনিরুজ্জামান আহমদ । তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের অন্যতম সদস্য এবং সিলেট সোসাইটি অব মেডিসিনের জেনারেল সেক্রেটারি।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ৩০০৩তম পর্বে প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান কোন পর্যায়ে রয়েছে?
উত্তর : এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়ে কথা বলার জন্য অনেক জ্ঞানীগুণী চিকিৎসক এবং নীতিনির্ধারক রয়েছেন,আমাদের নেতারা রয়েছেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন মহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আমার চেয়ে অনেক যোগ্যতার দাবি রাখেন। তবে আমি মনে করি, আমি যেহেতু তৃণমূলে কাজ করি, আমি ঢাকা থেকে বাইরে সিলেট মেডিকেলে চিকিৎসা করি, আমাদের যে অভিজ্ঞাতা, চিন্তা ভাবনাগুলো সেগুলো যদি পলিসি তৈরির সময় নির্ধারণীতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা চিন্তা করেন, সেটি আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে।
আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে যে অবস্থা, এর অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সাব সেন্টার ও জেলা হাসপাতাল।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ থেকে যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল, স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য দেশব্যাপী যে নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়, সেই অনুযায়ী আমরা কতদূর এগিয়েছি বা কতদূর এগোতে পেরিছি, সেটুকু মূল্যায়নের সময় আমার মনে হয় এসেছে। আমাদের যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল, সেখানে যারা গ্রামে বাস করে, তাদেরই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ৩০ ভাগ লোক আমাদের শহর এলাকায় বাস করে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মধ্যে আমাদের কমিউনিকেবল রোগগুলো ছিল। এরপর আমাদের চাইল্ড হেলথ কেয়ার ছিল। মাদার সেফটি, ভ্যাক্সিনেশন- এই প্রোগ্রামগুলোর ওপর গুরুত্ব ছিল। এখন আধুনিক যেসব রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির রোগ, ক্যানসার এগুলোর অতটা গুরুত্ব ছিল না। তবে এখন এগুলো এসেছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে তিনটি প্রধান উপাদান রয়েছে। একটি হলো স্বাস্থ্যসেবা, আরেকটি হলো শিক্ষা, আরেকটি হলো গবেষণা। তিনটি বিষয় কিন্তু একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। আপনি যদি স্বাস্থ্যসেবা ধরেন, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা আপনি কীভাবে দেবেন? স্বাস্থ্যসেবা দিতে গেলে স্বাস্থ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যের শিক্ষা উন্নত করতে হবে। কারণ, আপনি হয়তো হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলেন, তিনি চিকিৎসা দিলেন, তবে আমি রোগ নির্ণয় করলাম, চিকিৎসা দিলাম, কাউন্সেলিং করালাম- সেটি হলো গুণগত স্বাস্থ্যসেবা। গুণগত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। দুঃখজনক হলেও এই কথাটা সত্য। এর কারণ কী? আমাদের কমপ্রিহেনসিভ বা ইনটিগ্রেটেড যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অখণ্ড স্বাস্থ্য বা সমন্বয়ের স্বাস্থ্য যেটা বলেন, সেটি আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি।
প্রশ্ন : তবে বাংলাদেশে তো অনেক আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক রয়েছেন, অত্যন্ত ভালো চিকিৎসক রয়েছেন, কিছু কিছু ভালো সেন্টারও রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভালো ব্যবস্থাও রয়েছে। তার পরও যেই অভাবগুলো রয়েছে সেগুলো থেকে উত্তরণে পরামর্শ কী?
উত্তর : আমাকে যদি কোয়ালিটি হেলথ কেয়ার বা গুণগত স্বাস্থ্যসেবা দিতে হয়, এডুকেশনের কোয়ালিটি বা শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। আমাদের দক্ষ ক্লিনিসিয়ান তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক দক্ষ চিকিৎসক রয়েছেন। তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন, তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে অনেক পুরস্কার নিয়ে এসেছেন। তাঁদের নাম রয়েছে, সুখ্যাতি রয়েছে। তবে আমরা চাই একটি পদ্ধতি। আমি সব সময় যেই কথাটি বলি যে, যদি আপনি একটি পদ্ধতি তৈরি করেন, সেই পদ্ধতির মধ্যে আপনি ভালো গুণগত সাবান তৈরি করতে পারবেন এবং খারাপ মানের সাবানও তৈরি করতে পারবেন। স্বাস্থ্যসেবার পদ্ধতি যদি আপনি উন্নত করতে পারেন, তাহলে আমার ভালো পণ্য বের হয়ে আসবে। সেই ভালো পণ্যের জন্য আমার একটি ভালো শিক্ষা পদ্ধতি দরকার। সেই ভালো শিক্ষা পদ্ধতি থেকে পদ্ধতির জন্য আমার মনে হয়, আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি শিক্ষা পদ্ধতি হওয়া দরকার। এখানে আমাদের একটি ডাটাবেজ হওয়া দরকার। ধরুন, আপনার কার্ডিওলজিস্ট দরকার, হার্ট স্পেশালিস্ট দরকার। আপনি কি হাইপারটেনশন চিকিৎসার জন্য হার্ট স্পেশালিস্ট তৈরি করবেন, না কি ইন্টারভেনশন করার জন্য তৈরি করবেন। ইন্টারভেনশন সার্জিক্যাল বা মেডিকেলের দরকার হয়।
সেই ইন্টারভেনশনের জন্য আপনি কার্ডিওলজিস্ট তৈরি করবেন। আপনি শুধু রক্তচাপ মাপার জন্য কার্ডিওলজিস্ট তৈরি করবেন না। তাই কার্ডিওলজিস্ট তৈরি করতে গেলে আপনার দেশে হার্টের রোগীর সংখ্যা কত, সেই রোগীর কতজন কার্ডিয়াক স্পেশালিস্ট দরকার এবং সেই স্পেশালিস্ট কোয়ালিটি স্পেশালিস্ট কি না, যাঁরা ভালো ইন্টারভেনশন করতে পারেন, আন্তর্জাতিকমানের ইন্টারভেনশন করতে পারেন, সেই ধরনের কার্ডিওলজিস্ট কি না, সেটি দেখতে হবে। আপনি যদি নেফ্রোলজিস্ট তৈরি করতে চান, তাহলে দেখতে হবে আন্তর্জাতিকমানের নেফ্রোলজিস্ট যে ইন্টারভেনশন তৈরি করতে পারে, সেই ধরনের নেফ্রোলজিস্ট তৈরি করছেন কি না। না কি বিভিন্ন জায়গায় আমরা অসংখ্যভাবে ডিগ্রিগুলো দিয়ে দিচ্ছি, সেগুলো কি শুধু ডিগ্রি, না কি গুণগত ডিগ্রি। আমাদের একটি আন্তর্জাতিক মডেল অনুসরণ করতে হবে।
প্রশ্ন : ইনটিগ্রেটেড পদ্ধতিতে উন্নতি করার জন্য আপনার কী কোনো পরামর্শ রয়েছে?
উত্তর : ঘরে ঘরে তো কার্ডিওলজিস্ট আমার দরকার নেই। আমার কোন রোগের গুরুত্বটা বেশি। কোন রোগ সবচেয়ে বেশি সেই অনুযায়ী রেসপেরেটরি মেডিসিন তৈরি করতে হবে। ওই জায়গাটিতে গবেষণা দরকার, আইটি সেক্টরের কাজ হলো সেই জায়গাটিতে গবেষণা করা, যে আমাদের কোন ক্ষেত্রে কতজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করার জন্য গুণগত শিক্ষা প্রয়োজন।