খাবারে বিষ
ভেজালকারীরা জাতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রথমে দরকার বাতাস, এরপরই পানি ও খাদ্য। বাতাস যদিও নেওয়া যায়, সেটাও এখন দূষণের কবলে। তারপরের অপরিহার্য জিনিসটিই হলো খাদ্য। কিন্তু আমরা যা খাচ্ছি, তা সত্যই কি ভেজালমুক্ত?
খাদ্যদ্রব্যে মিশ্রিত ভেজালে রাজধানীসহ পুরো দেশের বাজার সয়লাব। মাঝে মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানের পরও থেমে নেই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, এমনকি ভেজালবিরোধী অভিযানও থামাতে পারছে না রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। সভ্য সমাজে খাদ্যে ভেজাল অকল্পনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোথায় ভেজাল নেই তা নিয়েই বোধ হয় গবেষণা করতে হবে। অনেকেই ভেজাল খাদ্যের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত, এমন কি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও চলছে ভেজাল। ভেজাল হচ্ছে শিশু খাদ্যেও। রাসায়নিকের ব্যবহার বেআইনি হলেও তা চলছে। লাভ ও লোভের বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষজন।
আজকাল বাজারে ফলমূলের দোকানে গেলে মৌমাছি আর চোখে পড়ে না, মাছের বাজারে নেই মাছের গন্ধ আর মাছির আনাগোনা। এর কারণ কি? উত্তর একটাই, তা হলো মাছে ফরমালিন মেশানোর ফলে বাজারে মাছের আঁশটে-পচা দুর্গন্ধ আর থাকে না। একইভাবে কোনো ফলমূলের দোকানেও মৌমাছির আনাগোনা নাই বললেই চলে, কারণ কারবাইড মেশানোর কারণে মৌমাছি আর মধু আহরণ করতে ওই ফলে যায় না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এগুলো বেশি দিন তাজা রাখার উদ্দেশে ফরমালিন, কারবাইড ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কিংবা অতি অল্প কালের মধ্যেই অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার নেশায় বুদ হয়ে থাকা এসব অসাধু ব্যবসায়ী তাদের এই অপকর্মের মাধ্যমে দেশের যে সর্বনাশ সাধন করছে তা ভবলেও গা শিউরে উঠে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় দুধ, ফল, মাছ-মাংসে এমনকি শাকসবজিতেও ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কার্বাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। শাকসবজি কোনটা খাওয়া নিরাপদ, কোনটা নয়- সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। ফলমূলে যেমন বিষাক্ত কেমিক্যাল, মাছে দুধে ফরমালিন, সবজিতে কীটনাশক- এর সাথে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য যেমন জিলাপি চানাচুরে মবিল মেশানো হয়। আরো শোনা যায় বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকস, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস, এমন কি মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার রং, পানিতে ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই, লবণে সাদাবালু, চায়ে করাতকলের গুঁড়া, গুঁড়া মসলায় ভূষি কাঠ বালু ইটের গুঁড়া ও বিষাক্ত গুঁড়া রং।
রমজানের সময় আমদানিকৃত খেজুরেও নাকি ভেজাল কেমিক্যাল মিশানো হয়ে থাকে। তাই কোনো খাবারই যে নিরাপদ নয় তা বলাই বাহুল্য। সবকিছু চলছে লাগামহীন, ফ্রি স্টাইলে। এসব কেমিক্যাল এক ধরনের বিষ, যা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। এমনও শোনা যায় যে অনেক ব্যবসায়ী ফরমালিন পানিতে মিশিয়ে বরফ তৈরি করে, আর সেই বরফে মাছ-মাংস সংরক্ষণ করে। বাজারে আম, জাম, কলা, লিচু এবং পেঁপে সবকিছুতেই কারবাইড মেশানো হয় এবং অনেক সময় ভেজালবিরোধী অভিযানে এসব ধ্বংসও করা হয়।
ফরমালিন সাধারণত মানুষের লাশসহ মৃত প্রাণীকে সতেজ রাখতে ব্যবহার করা হয়। ফরমালিনে ফরমালডিহাইড ছাড়াও মিথানল থাকে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। লিভার বা যকৃতে মিথানল এনজাইমের উপস্থিতিতে প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়। দুটোই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফরমালডিহাইড চোখের রেটিনাকে আক্রান্ত করে এর কোষ ধ্বংস করে। ফলে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কার্বাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে পেটের পীড়া, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এসব রাসায়নিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন-সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। লিভার ও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। হার্টকে দুর্বল করে দেয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়। শেষ পর্যন্ত ফরমালিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার হতে পারে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে। এতে মৃত্যু অনিবার্য।
মানবদেহে ফরমালিন ফরমালডিহাইড ও ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বাড়ায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। ফরমালিন কেবল ভোক্তাদের জন্য নয়, ফরমালিন মিশ্রণের সঙ্গে জড়িত লোকজন এবং মাছ বিক্রেতাদের জন্যও ক্ষতিকর। যারা কেমিক্যাল প্রয়োগকারী তাদেরও প্রত্যক্ষ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে যেমন যারা ক্যালসিয়াম কার্বাইড নিয়ে কাজ করে তাদের চুলকানি ও চর্মরোগ থেকে শুরু করে অস্থিমজ্জার ক্ষতি হয়ে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। ফরমালিন প্রয়োগকারীদেরও চর্মরোগের সাথে ফুসফুসের সংক্রমণ হতে পারে, এমন কি ক্যান্সারের ঝুঁকিও থাকে। এ ছাড়া কিডনিসহ অন্যান্য জরুরি অঙ্গেরও ক্ষতি হতে পারে।
ফরমালিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে দিন দিন শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে। বয়স্ক লোকেরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মেয়েদের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত দোষ-ত্রুটিসহ আশঙ্কাজনকহারে প্রতিবন্ধী, হাবাগোবা, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
এ ধরনের খাদ্য খেয়ে অনেক লোকজন আগের তুলনায় এখন কিডনি, লিভারের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগের সমস্যায় ভুগছে। দেখা যাচ্ছে, কয়েকদিন পরপর একই রোগী ডায়রিয়ায় ভুগছে, পেটের পীড়া ভালো হচ্ছে না, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একবার চিকিৎসা শেষে আবারও তারা একই রোগ নিয়ে হাজির হচ্ছে। আগে হাসপাতালে-ক্লিনিকে এত রোগী দেখা যেত না। ফল-দুধ-মাছ-মাংসে বিভিন্ন কেমিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব এই অবস্থার অন্যতম কারণ। দেশে মরণব্যাধি আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধির জন্য ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রণ করে বাজারজাত করাই দায়ী।
এই বিষক্রিয়ার ফল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর হবে ভয়াবহ। আজকের শিশুরাই তো আগামীর ভবিষ্যত্। ভেজাল খাবার কিংবা বিষাক্ত কেমিক্যাল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটা সাদা চোখে দেখা না গেলেও ধীরে ধীরে এর খারাপ ফলাফল আমরা পাব। মানুষকে ঘন ঘন হাসপাতালে যেতে হবে। এতে দিন দিন মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। শিশুরা কম বুদ্ধি সম্পন্ন হবে,স্মৃতিশক্তি থাকবে না, শরীরে শক্তি থাকবে না,ভারি কোনো কাজ করতে গেলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এরাই তো এক সময় দেশের নেতৃত্বে আসবে। বিভিন্ন পেশায় কম মেধাসম্পন্ন লোক ভরে যাবে। এদের মধ্যেই কেউ ডাক্তার হবে,কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে,কেউ সচিব হবে, কেউ রাজনীতিবিদ হবে। মোটকথা,একজন সন্ত্রাসী কাউকে খুন করলে একটা পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়,কিন্তু ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ করে একটা জাতি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে,এক সময় পুরো জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ার আশংকাযুক্ত হচ্ছে। দেশ এক ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে,যা একটা পেশাদার কিলারের চেয়েও ভয়ংকর।
এ থেকে প্রতিকার পেতে হলে সাধারণ মানুষকে বেশি সচেতন হতে হবে। বাজারে ফলমূল দেখেশুনে কিনতে হবে। নিরাপদ ফল চিনতে পারা এবং ফল কেনার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, দোকানে রাখা ফলমূলে মাছি না বসলে ফরমালিন থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। এমনকি মৌসুম শুরু হওয়ার আগে বাজারে ফলমূল এলে তা কাঁচা অবস্থায় পাকানো হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। আধাপাকা ফলে হলদে সবুজ রঙ থাকলে ধরে নিতে হবে কেমিক্যাল দেয়া আছে। জনগণকে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানাতে হবে।
সরকারকে আইনের মাধ্যমে এ সমস্যা নিরসন করতে হবে। ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার থেকে নিরাপদ থাকতে ভেজালবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। দেখা যায়, আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় ভেজাল রোধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি আইনে মাছ, মাংস, ফলমূল এবং সবজির ভেজাল পরীক্ষারও কোনো বিধান নেই। যারা খাবারে ভেজাল মেশায়, পরোক্ষভাবে তারা পুরো জাতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ জন্য তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। সরকার কঠোর হলেই খাবারে ভেজাল দূর করা সম্ভব। খাদ্যে ভেজাল পরীক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ, প্রশিক্ষিত জনবল নিতে হবে। প্রতিটি খাবার ভেজাল পরীক্ষা করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। ভেজালকারীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। মাঝে ভেজালবিরোধী অভিযানের সময় খাবারে ভেজাল দেওয়া কিছুটা কমে গিয়েছিল। মানুষও সচেতন হয়েছিল। কিন্তু এখন আবারও খাবারে ভেজালের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যারা জেনে শুনে মানুষকে বিষ পান করাচ্ছে তারা কোনোভাবেই সুস্থ মানুষ হতে পারে না। এ জন্য আমাদের ব্যবসায়ী, পাইকার বা আমদানিকারকরা যে কি মারাত্মক অপরাধ করে চলেছে তা তাদের বোঝা উচিত।
খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণের কারণে গোটা জাতিই যে পঙ্গুত্ব বরণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত সেই খেয়াল হয়তো বা কারোরই নেই। কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। যারা খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে প্রকারান্তরে মানুষ হত্যা করছে তাদের ব্যাপারে এখনই কঠিন না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রুগ্ন, ভগ্ন স্বাস্থ্য এমনকি পঙ্গু জনগোষ্ঠীর রূপ ধারণ করবে। মানুষের বেঁচে থাকার মূল ভিত্তি খাদ্য, তাতে বিষ মেশানোয় যদি জনসাধারণের ও কর্তৃপক্ষের টনক না নড়ে, তাহলে বলতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। জনগণের সম্পৃক্ততা, সচেতনতা এবং সরকারি উদ্যোগের দৃঢ়তার মাধ্যমেই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। এটা নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
লেখক : ডিন, মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ