স্বাস্থ্যকর খাবারের ৮ পরামর্শ
ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের মতে, ‘মানুষ যত বেশি আহার করে, তত বেশি ওষুধের প্রয়োজন পড়ে।’ ভোজনরসিক বাঙালির জন্য এ এক দুঃসংবাদই বটে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক খাবারটি খেলে বরং ওষুধ হিসেবেই কাজ করে খাদ্য। সহায়তা করে সুস্থ রাখতে।
স্বাস্থ্যকর খাবারের এমন আটটি পরামর্শ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ওয়েবসাইট এসএইচএস। তাদের মতে, এই আটটি ব্যবহারিক পরামর্শ স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রাথমিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে সুস্থ থাকতেও সহায়তা করে। স্বাস্থ্যকর ডায়াটের মূল কথা হচ্ছে, সঠিক পরিমাণ ক্যালরি খরচ ও গ্রহণে ভারসাম্য বজায় রাখা। অর্থাৎ যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ করবেন, সে পরিমাণই গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেলে ওজন বাড়বে। ক্যালরি খরচ না করলে চর্বি হিসেবে যুক্ত হবে। আবার তুলনামূলক কম খেলে ওজন কমবে। এ জন্য শরীর ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় খাবারও খেতে হবে, পুষ্টি গ্রহণ করতে হবে।
সাধারণত দিনে একজন পুরুষের ২৫০০ ক্যালরি দরকার হয় এবং একজন নারীর জন্য ২০০০ ক্যালরি দরকার। যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেয়ে থাকে, যা প্রত্যেকের কমানো উচিত। তবে এই আটটি পরামর্শ মানলে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ সহজ হবে।
খাবারগুলো আঁশযুক্ত ও শর্করানির্ভর করুন
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এক-তৃতীয়াংশ রাখা উচিত আঁশযুক্ত ও শর্করা জাতীয় খাবার। এর মধ্যে আলু, রুটি, ভাত, পাস্তা, মটরশুটি, সবজি, ফল ইত্যাদি রয়েছে। এর মধ্যে গোটা গ্রেন জাতগুলো বেছে নিতে পারলে আরো ভালো। বেশি কার্যকর। প্রতিটি খাবারের সঙ্গে অন্তত একটি শর্করা জাতীয় খাবার যুক্ত করা উচিত। অনেকের ধারণা, শর্করা শুধু মোটাতাজাই করে। কিন্তু এটি অনেকেই জানে না, শর্করা অর্ধেকেরও কম পরিমাণে ফ্যাট সংগ্রহ করে। মজার বিষয় হলো, খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত করে আমরা দায় চাপাই এই খাবারগুলোর ওপর। যেমন, রুটির ওপর মাখন, পাস্তাতে ক্রিমি সস, এগুলো ক্যালরির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
প্রচুর ফলমূল এবং নিরামিষ খেতে হবে
প্রতিদিন প্রচুর ফল খেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ প্রকারের ফল বা সবজি খেতে হবে। এগুলো তাজা, হিমশীতল, টিনজাত, শুকনো বা রসযুক্ত হতে পারে।
মাত্র পাঁচ দিন মানলেই এটি সহজ হয়ে যাবে। তখন সকালের নাশতায় একটি কলা কেন যুক্ত করবেন না? কিংবা একটি তাজা ফলের জন্য লাঞ্চটাইম একটু অদল-বদল হতেই পারে।
সবজি ও ফল খাওয়ার সময় একটু খেয়াল রাখবেন, সবজির অংশ ৮০ গ্রাম এবং শুকনো ফলের অংশ ৩০ গ্রাম হলে ভালো হয়। এ ছাড়া জুস করেও খাওয়া যেতে পারে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫০ মিলিলিটার পরিমাণ এক গ্লাস ফলের রস, উদ্ভিজ রস বা স্মুদি খেতে পারেন। তবে এগুলো চিনিযুক্ত এবং ঠাণ্ডা হলে প্রতিদিন এক গ্লাসের বেশি না খাওয়াই ভালো।
মাছে গুরুত্ব দিন
মাছ প্রোটিনের ভালো উৎস। এতে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ থাকে। এ জন্য প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় মাছ রাখা জরুরি। সঙ্গে প্রতিদিন কমপক্ষে এক টুকরো তৈলাক্ত মাছ খেতে পারলে ভালো। অথবা সপ্তাহে দুই টুকরো খাওয়ার চেষ্টা করুন। তৈলাক্ত মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাট বেশি থাকে। ফলে হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। তৈলাক্ত মাছের মধ্যে রয়েছে বোয়াল, রুই, স্যামন ইত্যাদি। অধিকাংশ মানুষের জন্যই মাছ বেশি খাওয়া জরুরি। তবে কিছু মাছ ক্ষতিকর। এগুলো লক্ষ রাখলেই চলবে।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও চিনি কমিয়ে আনা
স্যাচুরেটেড ফ্যাট
প্রত্যেক মানুষেরই ডায়েটে কিছু ফ্যাট দরকার আছে। তবে অবশ্যই পরিমাণ ও ধরনে মনোযোগী হতে হবে। এখানে দুই ধরনের চর্বি রয়েছে। স্যাচুরেটেড (সম্পৃক্ত) ও আনস্যাচুরেটেড (অসম্পৃক্ত) ফ্যাট। অত্যধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা হৃদরোগের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একজন পুরুষের দিনে ৩০ গ্রামের বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকা উচিত নয় এবং একজন নারীর দিনে ২০ গ্রামের বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট ক্ষতিকর। ১১ বছরের বাচ্চাদের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকা উচিত। তবে কম চর্বিযুক্ত ডায়েটে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই। স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে চর্বিযুক্ত মাংস, সসেজ, মাখন, হার্ড চিজ, ক্রিম, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি। স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার ত্যাগ করে উদ্ভিজ তেল, তৈলাক্ত মাছের মতো খাবারগুলো গ্রহণ করা উচিত।
চিনি
চিনিকে বলা হয় ‘হোয়াইট পয়জন’, অর্থাৎ সাদা বিষ। নিয়মিত উচ্চমাত্রায় চিনি খেলে স্থূলত্ব এবং দাঁত ক্ষয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। চিনিযুক্ত সুগন্ধি খাবার ও পানীয়গুলো বেশি পরিমাণে খেলে দ্রুত ওজন বাড়ে। মিষ্টির প্রতি যাদের দুর্বলতা, তাদের জন্য মধু, ফলের রস, দুধ, সিরাপ রয়েছে, যা প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। অনেক প্যাকেটজাত খাবার ও পানীয় রয়েছে, যা চিনিমুক্ত। প্রয়োজনে পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো। প্রতি ১০০ গ্রামে ২২.৫ গ্রাম চিনি থাকলে বুঝতে হবে চিনির পরিমাণ বেশি।
লবণ কম খেতে হবে
বেশি পরিমাণে লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা থাকে। আর উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। স্ট্রোকের ঝুঁকিও রয়েছে তাদের জন্য। অধিকাংশ খাবারের মধ্যেই লবণ থাকে। বলা যায়, আপনি যদি আলাদা করে লবণ না-ও খান, তবু বেশি খাচ্ছেন। প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে ১.৫ গ্রামের বেশি লবণ থাকা কোনোভাবেই উচিত নয়। ১১ বছরের বেশি বা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে ৬ গ্রাম, অর্থাৎ এক চা চামচ পরিমাণের বেশি লবণ খাওয়া ঠিক নয়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরো কম।
সক্রিয় হোন এবং স্বাস্থ্যকর ওজন নিশ্চিত করুন
স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত অনুশীলনও দরকার। সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য জরুরি। অতিরিক্ত ওজন যেমন ডায়াবেটিস, ক্যানসার, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে, তেমনি কম ওজনও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ওজন কমাতে কম খাওয়ার পাশাপাশি শারীরিক অনুশীলন বা ব্যায়াম বেশি কার্যকর, যা ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে।
বেশি করে পানি পান করুন
ডিহাইড্রেট হওয়া বন্ধ করতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। একজন মানুষের প্রতিদিন ছয় থেকে আট গ্লাস পানি পান করা উচিত। খাবারের সঙ্গে গৃহীত তরল ছাড়াও প্রচুর পানি পান করার উচিত। অ্যালকোহলবিহীন সব পানীয়ই গ্রাহ্য। তবে পানি, কম চর্বিযুক্ত দুধ, চা, কফি এবং কম চিনিযুক্ত পানীয় অধিক স্বাস্থ্যকর। বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় এবং অনুশীলনের সময় পানি খাওয়া ভুললে চলবে না।
সকালের নাশতা এড়ানো যাবে না
অনেকেই সকালের নাশতা এড়িয়ে যান। তাঁরা মনে করেন, এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অবশ্যই নিয়মিত সকালের নাশতা করতে হবে। ফাইবারের উচ্চামাত্রা এবং চিনি ও লবণের পরিমাণে নজর রাখলে সকালের নাশতা সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান সকালের নাশতা থেকেই হয়।