মুরের সূত্রের ভবিষ্যৎ কী?
‘প্রতি দুই বছরে কম্পিউটারের হিসাব করার ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে এবং একই সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ হবে সিলিকন চিপের ট্রানজিস্টারের সংখ্যা।’
প্রযুক্তির উন্নয়নের ভিত্তি বলে খ্যাত এই সূত্রটিকে বলা হয়, মুরস ল বা মুরের সূত্র। ১৯৬৫ সালে ইলেকট্রনিক ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুর প্রযুক্তি পণ্যের উন্নয়ন নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। এর পর থেকেই প্রযুক্তি পণ্যের উন্নয়নে এই বক্তব্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা গেছে।
বৈদ্যুতিক চিপের ধারাবাহিক উন্নয়নে সরাসরি লাভবান হয় প্রযুক্তি শিল্প। প্রতিটি নতুন চিপের সাধারণ বৈশিষ্ট হলো এটি পূর্বের চেয়ে আকৃতিতে ছোট কিন্তু শক্তিশালী এবং পূর্বের চেয়ে দামও কম। ২০১৫ সালে ইন্টেলের তৈরি চিপে ট্রানজিস্টারের সংখ্যা ১০০ কোটি।
চলতি সপ্তাহেই পঞ্চাশ পেরোলো মুরের সূত্র। কিন্তু ৬০ বছর পর্যন্ত সূত্রটি কি টিকে থাকতে পারবে? অনেক বিশেষজ্ঞেরই দাবি, বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নয়নের জোয়ারে একসময় প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে। এমনটি দেখা দিতে পারে পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই। তাই ৬০ বর্ষপূর্তির পূর্বেই মুরের সূত্রের গুরুত্ব হারাতে পারে।
ইন্টেল বা এর মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চিপ তৈরির পদার্থবিজ্ঞানের সীমার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ২০১০ সালের এক সাক্ষাৎকারে মুরও নিজেও এমন তথ্য জানান। তিনি বলেন, ট্রানজিস্টারগুলো ছোট হতে হতে একসময় এটি অনুর পর্যায়ে পৌঁছাবে। এর চেয়ে ছোট যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। তখন একটাই পথ থাকবে কম্পিউটারকে শক্তিশালী করা। এই করতে গিয়ে চিপের ট্রানজিস্টারের সংখ্যা বাড়বে তাই আকৃতি বড় হতে থাকবে। এর ফলে দামও বেড়ে যাবে। যা মুরের সূত্রের পুরো উল্টো।
মুরের সূত্র ও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা কম। এঁদেরই একজন ইন্টেলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা স্টেসি স্মিথ। তাঁর অন্যতম কাজ হলো প্রকৌশলীদের মাধ্যমে মুরের সূত্রকে বাঁচিয়ে রাখা। সম্প্রতি প্রযুক্তি বিষয়ক সাময়িকী ‘রিকোডের’ কাছে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইন্টেলের সামনে চিপের উন্নয়নের মাত্র কয়েকটি ধাপ বাকি আছে। এরপর আর উন্নয়ন সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন।
স্মিথ বলেন, মুরের সূত্রের প্রযুক্তিগত দিকের অর্থনৈতিক গুরুত্বই বেশি। তাঁর মতে, ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে চিপের দাম এতটাই কমে এসেছে যে একজন কম্পিউটারের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা ভাবতেই পারে।
চিপের উন্নয়নের ধারার সমাপ্তিই ইন্টেলের কাছে এখন সবচেয়ে ভাবনার বিষয়। ইন্টেলের অত্যাধুনিক চিপগুলোর অর্ধেকই ১৪ ন্যানোমিটার। এই চিপগুলো ধীরে ধীরে আগের ২২ ন্যানোমিটারের স্থান দখল করে নেবে।
এক ন্যানোমিটার হলো এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের একভাগ। ১৪ ন্যানোমিটার একটি সাধারণ ভাইরাসের (মানুষের রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী) চেয়েও ছোট।
স্মিথ বলেন, ইন্টেল কয়েক বছরের মধ্যেই ১০ ন্যানোমিটার চিপ তৈরি করবে। তবে কবে নাগাদ এই কাজ শুরু হবে এ প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান। ইন্টেলে অগ্রগতির ধারা অনুসারে ধারণা করা যায়, আগামী বছরের শেষ নাগাদ এমন চিপ তৈরি শুরু হবে।
স্মিথের তথ্য অনুযায়ী, ১০-এর পর ইন্টেল সাত ন্যানোমিটার চিপ তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ শুরু করবে। যদি সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলে তবে আগামী ২০১৮ নাগাদ সাত ন্যানোমিটার চিপ বাজারে আসতে পারে। এর পরের লক্ষ্য হবে পাঁচ ন্যানোমিটার, যা ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বাজারে আসতে পারে। জীবের বংশগতির ধারক ডিএনএ (ডি-অক্সি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড)-এর দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণ। ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ ন্যানোমিটার চিপই বাজারে চলবে। কিন্তু এরপর চিপের আকৃতি আর ছোট করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অনেক প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু তখনো মুরের সূত্রের ৬০ বর্ষপূর্তি হতে বাকি আরো তিন বছর। অর্থাৎ এখন থেকে সাত বছর পরই মুরের সূত্র আর খাটবে না।
কিন্তু কেন থেমে যাবে চিপের উন্নয়ন। তবে কি চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট গবেষণা করছে না। বাস্তবে ইন্টেল গত কয়েক বছরে গবেষণায় ব্যয় বাড়িয়েছে। সর্বশেষ গত বছর ইন্টেল চিপ নিয়ে গবেষণায় ব্যয় করেছে এক হাজার ১০৫ কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্বের অন্য যে কোনো চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই ব্যয় বেশি। শুধুমাত্র এই বিশাল ব্যয়ের কারণেই চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে এসেছে। এক দশক আগেও বিশ্বে শীর্ষ চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল ১৮টি। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র চারটিতে- ইন্টেল, স্যামসাং, গ্লোবালফাউন্ডারিস ও তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটর ম্যানুফ্যাকচারিং করপোরেশন।
তবে গবেষকরা ইন্টেল বা অন্যান্য চিপ প্রস্তুতকারীদের চেয়ে কিছুটা আশাবাদী। অনেক গবেষক আশা করেন, তিন বা এক ন্যানোমিটার চিপও তৈরি করা যাবে। এ ছাড়া অনেক গবেষক চিপ তৈরির জন্য সিলিকনের বদলে অন্য পদার্থ ব্যবহারের পক্ষে। আর ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক ফসফরাস নামক পদার্থের একটি মাত্র অণু দিয়ে চিপ তৈরি করেন। তবে এটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে গবেষণাগারে অত্যন্ত নিখুঁত আবহাওয়ায় চিপ তৈরি ও উপস্থাপন এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে।
বর্তমানে ৮৬ বছর বয়সী মুর এখনো তাঁর গবেষণা প্রতিবেদন ও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।