অভিবাসীদের প্রতিভা যেভাবে অপব্যয় হচ্ছে ইতালিতে!
ফিলিপাইনের মাধ্যমিক স্কুলে গণিতের শিক্ষক ছিলেন মারলিয়ান নাবর। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই শিক্ষক ১৪ বছর আগে ইউরোপের দেশ ইতালিতে পাড়ি জমায়। ওই সময় তার মনে ছিল সীমাহীন আশা। বর্তমানে মারলিয়ানের বয়স ৪৯। ইতালির রাজধানী রোমের একটি বাড়িতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করেন এই ফিলিপাইন নাগরিক। বাড়ির মাকড়সার জাল ও ক্রোকারিজ গণনায় এখন তার কাজ। এমনকি, নিজের দেশে ফেরার আশাও হারিয়েছেন মারলিয়ান। এই নারী বলেন, ‘আমার দেশের ডিপ্লোমা বা পাঠ্যক্রমকে স্বীকৃতি দেয় না ইতালি। এর জন্যই আমি পেশাদার কোনো কাজ করতে পারি না।’
উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে মারলিয়ানার পথের পথিক হয়েছেন ২৬ বছর বয়সী অভিবাসী অভিষেক। এই ভারতীয় যুবক গত তুরিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন। তবে, এই উচ্চ শিক্ষা তার কোনো কাজে আসেনি।
নিজের নামের উপাধি দিতে অনিচ্ছুক অভিষেক বলেন, ‘আমাকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এর মূল কারণ, তার ইতালির ভাষাকে অপর্যাপ্ত মনে করা হয়েছিল।’ বর্তমানে নেদারল্যান্ডে রয়েছেন অভিষেক। সেখানকার একটি ফার্মে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত তিনি। ইউরোপের দেশটিতে ইংরেজিতেই কথা ও কাজকর্ম সারেন এই ভারতীয়।
ইতালিতে এরকম ঘটনা নতুন নয়। আরও অনেক অস্বস্তিকর সত্যের দেখা মেলে প্রায়শ। ইতালিতে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মীদের জন্য খুব কম সম্ভাবনা রয়েছে। উচ্চ শিক্ষা বা কাজে যোগ্য হওয়ার পরও অভিবাসীরা পিছিয়ে রয়েছে ইতালি সরকারের বিভিন্ন আইনের জন্য। দেশটিতে অভিবাসীদের ওয়ার্ক পারমিট আইন মানা হয় কঠোরভাবে। আজ শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) এমনটি জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে গণমাধ্যমটি বলছে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের ঠিক বিপরীতে হাঁটছে ইতালি। দেশটিতে অভিবাসী চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ও অন্যান্য চাকরি ক্ষেত্রের উচ্চ পর্যায়ে অভিবাসীদের দেখা মেলে না। দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে তাদের দেখা দুষ্কর। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত থাকা ইতালিতে জনসংখ্যা ক্রমাগত হারে কমছে। একইসঙ্গে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা।
গত মাসে ইইউর পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউরোস্টার্ট জানিয়েছিল, ইইউভুক্ত দেশগুলো ছাড়া ইতালিতে কাজ করা ৬৭ শতাংশ অভিবাসী অতিরিক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তারা মাধ্যম বা নিম্ন কাজগুলো করছে।
ইতালির এই হার ইইউর মোট গড় হারের থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। ২৭ দেশের এই জোটে ইতালির পরে রয়েছে গ্রিস। অন্যদিকে, ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ।
অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, দক্ষতা সম্পন্ন নাগরিকদের প্রস্থানের সঙ্গে লড়াই করছে ইতালি। ক্রমবর্ধমান দক্ষ শ্রমের ঘাটতি পূরণের জন্য তাদের অভিবাসীদের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
রয়টার্স বলছে, উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর কর্মক্ষেত্রে তেমন ইংরেজি ব্যবহার হয় না, যা ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলগুলো থেকে আলাদা। বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হলেও ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলো ইংরেজি ব্যবহারে অনাগ্রহী।
ইতালির ৫০ লাখ অভিবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই বেকার বা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বেশিরভাগ অভিবাসী কম দক্ষতা সম্পন্ন কাজ করে থাকে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফ্যাক্টরি, নির্মাণ কাজ ও ছোট দোকানগুলোতে কাজ করে অভিবাসীরা।
ইউরোস্টার্টের তথ্য মতে, এই দশকের শুরু থেকে ইতালির মোট দেশীয় পণ্য উৎপাদন স্বল্প পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি সঙ্গে কিছুটা ভারসম্য আসা ও শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা শূন্য দশমিক চার শতাংশ বেড়েছে। এমনটি হয়েছে ১১৯৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ইতালির এই গড় হার ইইউর গড়ের এক তৃতীয়াংশেরও কম।
তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক ফিলিপ্পো বারবেরা বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে দক্ষতা সম্পন্ন অভিবাসীদের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের নিজেদের কর্মজীবীদের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেনি। এর পরিবর্ততে অভিবাসীদের আগমনকে তারা বিপদ হিসেবে বিবেচনা করছে। এমনকি, অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না বলে অজুহাত দিচ্ছে তারা।’
চলতি মাসে গোটা ইতালিজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। সম্প্রতি ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালিতে অভিবাসীদের আগমন বেড়ে যাওয়ায় এই জরুরি অবস্থা জারি করেছে ডানপন্থি সরকার।
ছয় মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর মসদনে বসা মেলোনি অভিবাসী প্রত্যাশীদের ঠেকাতে আরও কঠোর হওয়ার কথা জানিয়েছেন। নির্বাচনের আগ থেকেই এই আভাস দিয়ে আসছিলেন তিনি। উপকূলীয় অঞ্চলে নৌকায় ভাসতে থাকা অভিবাসন প্রত্যাশীদের মেলোনি সরকারের তেমন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে, সম্প্রতি বৈধ পথে আসা অভিবাসীদের জন্য সুখবর দিয়েছেন তিনি। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বৈধ পথে আসাদের জন্য কয়েকটি আইনি প্রক্রিয়ার চ্যানেল খোলা হবে।’ তবে, এখনও সেই প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি ইতালির প্রশাসনকে।
এদিকে, ইতালির অর্থনৈতিক সমাধানে যোগ্য হতে পারে অভিবাসীরা, এমন পরিকল্পনাকে না করে দিয়েছেন মেলোনি। গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘অভিবাসীদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার আগে আমাদের আরও নারীকে কাজে সংযুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে জন্মহার বাড়াতে হবে। এগুলোই আমাদের কাছে অগ্রাধিকার পাবে।’
ইতালি সরকারের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য এ পর্যন্ত দুই লাখ ৭৭ হাজার আবেদন জমা পড়েছে দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ে। তবে, এর মধ্যে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিক নয় এমন ৮৩ হাজার আবেদনকারীকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মানে দাঁড়ায়, প্রায় সাড়ে তিনটি আবেদনে মধ্যে একটি আবেদনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেসব আবেদনকারীকে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগকে খণ্ডকালীন, মৌসুমি ও অদক্ষতামূলক চাকরির পারমিট দেওয়া হয়েছে।