সৌদি-ইরান বৈরিতা যে ভূমিকা রেখেছে মধ্যপ্রাচ্যে
সৌদি আরব ও ইরান নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক মিশন পুনরায় খোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সম্মত হয়েছে। এই সম্মতির পাশাপাশি দুদেশ তাদের মধ্যে বিমান চলাচলও শুরু করতে চায়। সম্প্রতি সেদিকেই হাঁটছে তেহরান ও রিয়াদ।
বছরের পর বছর ধরে তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে চিড় ধরা সম্পর্কের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণে গত শুক্রবার একটি সমঝোতায় পৌঁছান সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সউদ ও তার ইরানি প্রতিপক্ষ হুসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে এই সমঝোতা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই ক্ষমতাধর দেশ গত ১০ মার্চ চীনের মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে পৌঁছে। তবে, শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত ইরান ও সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সৌদি আরব বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে আছে।
সিরিয়া
প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের ছক বাঁধে ২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধের শুরু হওয়ার পর। ইরান এই যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষ নেয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে থাকে। অন্যদিকে, সৌদি আরব বাশারকে পদচ্যুত করতে এই যুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়।
যেহেতু ইরানের সমর্থন বাশার আল-আসাদকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছিল, আর বিদ্রোহীদের প্রতি সৌদি আরবের সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন ক্রমেই কমে আসছিল, তাই সৌদি কর্তৃপক্ষ সিরিয়ার সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে।
সৌদি-ইরানের চুক্তির কারণে বাশার আল-আসাদ আরব দেশগুলো থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন, তা রোধে বরফ গলতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, সিরিয়া আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আরব লীগে ফিরতে পারে।
লেবানন
ইরান ও সৌদি আরবের শত্রুতার কারণে লেবাননের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। ভূমধ্যসাগরের ছোট এই দেশটিতে ক্ষমতায় থাকার জন্য শাসকগোষ্ঠী অনেক আগে থেকেই বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করত।
বছরের পর বছর ধরে সুন্নি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থনের মাধ্যমে লেবাননের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক বেশ ভালোই যাচ্ছিল, কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর যখন লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিচেল আওনকে ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহ সমর্থন দেয়।
২০১৭ সালের নভেম্বরে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করেন। পরে হারিরি তার সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রাণনাশের চেষ্টা ও ইরানপন্থি হেজবুল্লাহর প্রভাবকে দায়ী করেন।
যদিও পরে হারিরি তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু, তার সিদ্ধান্তগুলোর কারণে দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে।
ইরাক
ইরাকে ইসলামিক রিপাবলিক ইরানের প্রভাব দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতাকালীন সময়ে আট বছরের যুদ্ধের কারণে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তবে, একুশ শতকে এসে ইরান ইরাকের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়, বিশেষ করে ২০০৩ সালে সাদ্দামের পতনের মধ্য দিয়ে।
ইরান শিয়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইরাকের আধাসামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণসহ তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। পরবর্তীতে এই বাহিনীটি দেশটিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান নেয়। যদিও তাদের লক্ষ্য ছিল আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
অন্যদিকে, বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত সরকার প্রতিবেশি আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ শুরু করলে সৌদি আরবের সমর্থন পায়।
ইয়েমেন
২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ইয়েমেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। তারা হুথি বিদ্রোহীদের দমন করতে এবং প্রেসিডেন্ট আবদো-রাব্বু মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় পুনরায় বসাতে এই অভিযান চালায়। তাদের অভিযোগ ছিল—দেশটিতে ইরানের প্রভাব ক্রমান্বয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
তবে, হাদি সরকারের বিরুদ্ধে ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত মুসলিম জনগোষ্ঠী ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ২০১৪ সালে তারা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা দখলও করে নেয়। পরে হুথি বিদ্রোহীরা দক্ষিণ দিকে রাজধানী সানার দিকে আসতে শুরু করলে হাদি তার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ থেকে পালিয়ে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে এডেনে চলে যান।
এই অস্থিতিশীলতার সুযোগে আরও বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান হয় দেশটিতে যার মধ্যে রয়েছে আল কায়েদা ও এসটিসি নামের সংগঠন।
২০১৫ সাল নাগাদ সৌদি নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী ইয়েমেনে ২৪ হাজারেরও বেশি বিমান হামলা চালায়। অন্যদিকে, ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা আরব সাগরে সৌদি অয়েল ট্যাঙ্কারসহ সৌদি আরবের গ্যাস ফিল্ড, বিমানবন্দরসহ কৌশলগত লক্ষবস্তুতে হামলা অব্যাহত রাখে।
এ সময় জাতিসংঘের উদ্যোগে বেশ কিছু আলোচনার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ২০২২ সাল নাগাদ দেশটির তিন কোটি জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেক লোক খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। দেশটির অর্ধেকেরও বেশি শিশু মুখোমুখি হয় চরম পুষ্টিহীনতার।