মণিপুরে কেন শান্তি ফেরাতে পারছে না ভারত?
কয়েক মাস বিরতির পর ভারতের মণিপুর রাজ্যে সমতলের মেইতেইদের সঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত কুকিদের আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে৷ এক বছরেরও বেশি আগে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষের দুই পক্ষকে এক করতে না পারায় সরকারের সমালোচনা হচ্ছে৷ এক বছর ধরে চলা সংঘর্ষে ২২৫ জন মারা গেছেন বলে সরকারি তথ্য বলছে৷ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এখনো ঘর ছাড়া৷
নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয় ১ সেপ্টেম্বর৷ মণিপুরের পুলিশ বলছে, কুকিরা মেইতেইদের এলাকায় ড্রোন হামলা করেছে৷ তবে কুকিদের দাবি, মেইতেইরা ড্রোন ব্যবহার করেছে৷ এই সংঘর্ষে এবারই প্রথমবার ড্রোন ব্যবহারের কথা শোনা গেল৷ এছাড়া রকেটও ব্যবহার হয়েছে বলে জানা গেছে৷
মেইতেইরা মূলত হিন্দু৷ তারা রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলের আশেপাশে থাকেন৷ আর কুকিরা মূলত খ্রিষ্টান৷ তারা থাকেন পাহাড়ি এলাকায়৷
রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা?
পরিস্থিতি শান্ত করতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অ্যাক্টিভিস্টরা৷ প্রধানমন্ত্রী মোদির এখনো মণিপুর সফর না করার বিষয়টিও সামনে আনছেন অনেকে৷ ‘‘মণিপুরে জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং সে কারণেই মণিপুরীদের ক্ষোভ গভীর হচ্ছে,’’ বলে ডিডাব্লিউকে জানান নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মণিপুরী অ্যাক্টিভিস্ট৷
মানবাধিকারকর্মী বিনালক্ষ্মী নিপ্রাম বর্তমান সময়কে মণিপুরের ইতিহাসের ‘সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়’বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷ ‘‘পরিস্থিতি শান্ত করতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ থেকে ৭০ হাজার সদস্যকে উড়িয়ে আনা হয়েছে৷ কিন্তু দুঃখজনক হলো তারা কিছুই করেনি,’’ বলেন নিপ্রাম৷
“মণিপুরের মানুষ একেবারেই হতবাক৷ ভারত কীভাবে তার অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোয়েন্দা ও প্রযুক্তি দিয়ে দেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? ১৬ মাস ধরে এমনটা চলছে৷ প্রত্যেক মণিপুরী এই প্রশ্নটাই করছেন,’’ যোগ করেন তিনি৷
উত্তেজনার কারণ
কুকি শিক্ষার্থীদের নেতা তেলাং লেতমিনলেন হাওকিপ বলছেন, কয়েক দশক ধরে তার সম্প্রদায়ের লোকজন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷
“আমরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষিত হয়েছি৷ পাহাড়ে ও সমতলে বসবাসকারীদের মধ্যে বিশাল অবিশ্বাস রয়েছে৷ পাহাড়ে খুব কমই উন্নয়নমূলক কাজ হয়৷ সমতলে ভালো সব অবকাঠামো রয়েছে,’’ বলেন তিনি৷
৪০ বছর বয়সি মেইতেই সম্প্রদায়ের সদস্য সুরজিৎ জাতিগত বিভাজনকে ‘টিকিং টাইম বোমা, যা বিস্ফোরিত হয়েছে’আখ্যায়িত করে বলেন, মেইতেইদের পাহাড়ে জমি কিনতে দেওয়া হচ্ছে না৷ কুকিরা মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে এসেছেন এবং তারা পপি চাষ ও মাদকপাচারের সঙ্গেও জড়িত।
অতীত সরকারগুলোর ব্যর্থতা
১৯৪৯ সালে মণিপুর ভারতের অংশ হয়৷ কয়েক দশক ধরে সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চলে আসছে৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতের সরকারগুলো সংঘাতের মূল কারণটির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ নতুন দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকা শাসকেরা ঐতিহাসিকভাবে বিষয়টিকে নিয়ে অবহেলা করে এসেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, মণিপুরে শান্তি প্রচেষ্টার মারাত্মক অভাব রয়েছে৷
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মণিপুরী অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, ‘‘শান্তি প্রচেষ্টা বিষয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসার আনুষ্ঠানিক আহ্বান ছাড়া আর কিছু ঘটতে দেখিনি৷”
মানবাধিকারকর্মী নিপ্রাম বলেন, “গত এক বছরে কোনো শান্তি আলোচনা না হওয়াটা দুঃখজনক৷ ভারত সরকারের উচিত ছিল বিভিন্ন জাতিকে একত্রিত করা এবং নিশ্চিত করা যে সেখানে আস্থা তৈরির ব্যবস্থা রয়েছে৷ আমাদের ড্রোনের দরকার নেই, আমাদের সংলাপ দরকার৷ আমাদের রকেটলঞ্চার দরকার নেই, আমাদের পুনর্মিলন দরকার৷ আমাদের মধ্যস্থতা দরকার, মারপিট নয়।’’