বিরল রোগ হান্টিংটন্স নিয়ে ট্রায়াল দেখাচ্ছে আশার আলো
পৃথিবীরে বুকে সবচেয়ে নির্মম ও ধ্বংসাত্মক যে রোগগুলো রয়েছে, সেগুলোর অন্যতম ‘হান্টিংটন্স রোগ’। পরিবার থেকে পরিবারে বংশ পরম্পরায় এই রোগ মানুষের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে (ব্রেন সেল) ধীরে ধীরে মেরে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় ডিমেনশিয়া, পারকিনসন্স ও মোটর নিউরন ডিজিজের মতো রোগগুলোর সংঘবদ্ধ সংক্রমণ। খবর বিবিসির।
তবে প্রথমবারের মতো ভয়ঙ্কর এই রোগটির সফল চিকিৎসার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গবেষকদের একটি দল বেশ আবেগতাড়িত হয়েই জানিয়েছেন, রোগীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে–এই রোগটির সংক্রমণ শতকরা ৭৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে এজন্য চিকিৎসা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জিন থেরাপির মাধ্যমে রোগীর জন্য প্রয়োজন ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টার জটিল ব্রেন সার্জারি।
গত দুই দশকে হান্টিংটন্স রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তবে গবেষণায় দেখা যায়, চিকিৎসা হলে বংশধারার মাধ্যমে সংক্রমিত এই রোগের আবির্ভাবের লক্ষণ ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের হান্টিংটন্স ডিজিজ সেন্টারের পরিচালক সারাহ তাব্রিজি গবেষণার এই ফলাফলকে ‘দৃষ্টিনন্দন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি রোগ নিরাময়ের বা রোগ ঠেকিয়ে রাখার হার ৭৫ শতাংশ হবে।’
এই গবেষণায় অংশ নেওয়া রোগীদের কাউকে চিহ্নিত করা না গেলেও জানা গেছে, একজন ইতোমধ্যে হাসপাতাল ছেড়ে তার কাজে যোগ দিয়েছেন। আর অন্যদের চলাফেরার জন্য হুইলচেয়ার ব্যবহার করার কথা থাকলেও তারা এখন হাঁটতে পারছেন। তবে এই চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মূলত হান্টিংটন্স রোগটি আমাদের শরীরের ডিএনএ’র হান্টিংটিন জিনের ত্রুটির কারণে সৃষ্টি হয়। রোগটি এরকম যে, এটি যদি আপনার বাবা-মায়ের হয়ে থাকে, তবে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকবে যে আপনিও এই ক্ষতিকর জিনটির বাহক হতে পারেন, যার অর্থ আপনার হান্টিংটন্স রোগ হবে। এই রোগে মগজের স্বাভাবিক প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে হান্টিংটিন প্রোটিন তৈরি হয়ে নিউরনের কোষগুলোকে মেরে ফেলে। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো বিষাক্ত এই প্রোটিনের উৎপাদন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, একবার মাত্র ওষুধ প্রয়োগে। এই প্রক্রিয়ায় একটি নিরাপদ ভাইরাসকে রিয়েল টাইম এমআরআই স্ক্যানিং ব্যবহার করে মস্তিষ্কের গভীরে প্রবেশ করানো হয়। এটি করা হয় মস্তিষ্কের দুটি অঞ্চল কডেট নিউক্লিয়াস ও পুটামেনে। জটিল এই নিউরোসার্জারি করতে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে।
এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাসটি মাইক্রোস্কপিক পোস্টম্যানের মতো কাজ করে। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের কোষে নতুন এক ধরনের ডিএনএ তৎপর হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে নিউরনগুলো একটি কারখানার মতো কাজ করে, যাতে সেগুলো নিজের মৃত্যু এড়াতে পারে। কোষগুলো এক ধরনের জেনেটিক উপাদান মাইক্রো আরএনএ উৎপাদন করে। এর ফলে মস্তিষ্কে হান্টিংটিনের মাত্রা কমে যায়।
মোট ২৯ জন রোগীর ওপর এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি পরিচালিত হয়। এর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, সার্জারির তিন বছর পরে রোগটি ছড়ানোর মাত্রা ৭৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের কোষকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে সংক্রমণ থেকে।
গবেষণায় সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক এড ওয়াইল্ড বলেন, ‘এই ফলাফলের জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আমরা কখনো ভাবিনি এরকম ফলাফল আসতে পারে।’
অধ্যাপক ওয়াইল্ড আশা করছেন এই থেরাপি একবার নিলে তা সারা জীবনের জন্য কাজ করবে।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে হান্টিংটন্স রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। আর এই রোগের বাহক হয়ে জীবনযাপন করছেন আরও হাজার হাজার মানুষ।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তাব্রিজি বলেন, এই জিন থেরাপিকে চিকিৎসার শুরু হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার মাধ্যমে থেরাপির দরজা উন্মুক্ত হবে আরও অনেক মানুষের জন্য।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক