ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে ফিলিস্তিনি বন্দিদের নির্যাতনের বিস্তারিত তথ্য
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর ইসরায়েলি ভয়াবহ নির্যাতনের আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। ফিলিস্তিনি আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বেশ কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের রামলা কারাগার কমপ্লেক্সের ভূগর্ভস্থ রাকেভেত সেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে তারা সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত এবং চরম সহিংসতার শিকার।
আইনজীবীদের দাবি, বন্দিদের ওপর হামলা, অনাহারে রাখা এবং গুরুতর আহত হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা না দেওয়ার ঘটনাও ঘন ঘন ঘটছে।
আইনজীবী নাদিয়া দাক্কা আল জাজিরাকে বলেন, ‘যখন বন্দিরা সাক্ষাৎকারের জন্য আসে, তাদের মুখেই বোঝা যায় তারা কী সহ্য করেছে… বিশেষ করে এই কারাগারে বন্দিরা কথা বলতে ভয় পায়। সাক্ষাৎকারের ঘরটি মাত্র এক বর্গমিটার, আর পাহারারক্ষীরা বের হতেও অস্বীকার করে।’
তবে দাক্কা ও তার সহকর্মীরা রাকেভেতে আটক একাধিক বন্দির সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
একজন বন্দি, যাকে ‘ওয়াইএইচ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে, তার চোয়াল, কাঁধ ও পাঁজর ভাঙা—কিন্তু কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। আরেক বন্দি ‘কেএইচডি’ জানান, কারারক্ষীরা শাস্তি হিসেবে বন্দিদের ‘বুড়ো আঙুল ভেঙে দেয়’।
ব্যাপক নির্যাতনের নতুন প্রমাণ
ইসরায়েলের কারাগার ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। গাজা উপত্যকায় দুই বছরের গণহত্যামূলক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনি ধরপাকড় আরও তীব্র হওয়ায় এ নির্যাতন বেড়েছে।
ফিলিস্তিনি অধিকার সংগঠন ‘আদ্দামির’-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৯ হাজার ২০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি কারাগারে আটক। এদের বেশিরভাগই কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই তথাকথিত প্রশাসনিক আটকাদেশে বন্দি।
গাজা থেকে আটক বেশ কয়েকজনকে দক্ষিণ ইসরায়েলের কুখ্যাত সামরিক বন্দিশিবির স্ডে তেইমান–এ রাখা হয়েছে, যেখানে হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, যৌন সহিংসতা—এমনকি ধর্ষণের মতো অভিযোগও উঠেছে।
যদিও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা সেইসব সেলে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।
যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গাজায় ফেরত দেওয়া নিহত ফিলিস্তিনি বন্দিদের দেহে নির্যাতন, বিকৃতকরণ ও ফাঁসির চিহ্ন দেখা গেছে—কিছু দেহে গলায় দড়িও বাঁধা ছিল।
নিপীড়ন আরও কঠোর করার পথে ইসরায়েল
ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, কারাগারে নির্যাতন এখন পদ্ধতিগত। পাবলিক কমিটি অ্যাগেইনেস্ট টর্চার ইন ইসরায়েল (পিসিএটিআই) জানায়, শারীরিক নির্যাতন, যৌন সহিংসতা, হয়রানি ও হুমকিসহ ব্যাপক নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেছে—যা ইসরায়েলের সুপরিকল্পিত নিপীড়নের ইঙ্গিত দেয়।
এরই মধ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকার ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নীতি নিতে চাইছে।
এই সপ্তাহে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট একটি বিল এগিয়ে নিয়েছে যা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামলার জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পথ খুলে দেবে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এ আইন শুধুই ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করবে। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের ওপর হামলা এ আইনের আওতায় আসবে না।
আদ্দামির বলেছেন, শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রবর্তনের উদ্যোগ নিপীড়নের নতুন অধ্যায় এবং এটি ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আরও বৈধতা দিচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ ‘গোপন’ কারাগার—ব্যবস্থারই অংশ
বীরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাসিল ফাররাজ বলেন, ভূগর্ভস্থ রাকেভেত কারাগারটি আসলে ইসরায়েলের বিস্তৃত নির্যাতন ব্যবস্থারই একটি অংশ।
বাসিল ফাররাজ বলেন, অনেক ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলের ‘অবৈধ যোদ্ধা’ আইনে আটক করা হয়েছে—যেখানে কোনো অভিযোগ প্রমাণ না করেই অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা যায়।
ফাররাজ বলেন, কোনো বিচার ছাড়াই আটক থাকা মানসিক নির্যাতনের আরেক স্তর সৃষ্টি করে। কেন আটক করা হয়েছে তা না জানা—এ সবকিছুই গত দুই বছরে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত সহিংসতা ও নির্যাতনের গভীরতাকে তুলে ধরে।’

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক