যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুমোদন করল ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা

গাজায় দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চালানো আগ্রাসন অবসানের পথে এক ধাপ এগিয়েছে ইসরায়েল। আজ শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সকালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর জানিয়েছে, হামাসের সঙ্গে হওয়া জিম্মি মুক্তি চুক্তির কাঠামোটি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেছে। ইসরায়েল এর আগে জানিয়েছিল, চুক্তির প্রথম ধাপে ‘সব পক্ষই’ স্বাক্ষর করেছে। বন্দিদের মুক্তিই পারে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে। খবর বার্তা সংস্থা এএফপির।
মিসরের শারম আল শেখ শহরে রুদ্ধদ্বার পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে চুক্তিটি চূড়ান্ত রূপ নেয়। এই চুক্তিটি মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত মাসে ঘোষিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার অংশ। ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি রোববার মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। মিসর চুক্তি সমাপ্তি উদযাপন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এ ছাড়াও ইসরায়েল সফর এবং বিধ্বস্ত গাজা পরিদর্শনও করতে পারেন ট্রাম্প।
চুক্তির বাস্তবায়ন ও জিম্মি মুক্তি
ইসরায়েলি সরকার জানিয়েছে, চুক্তি অনুমোদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সরকার ‘জীবিত এবং মৃত সকল জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কাঠামোটি অনুমোদন করেছে।
ইসরায়েলি সরকারের মুখপাত্র শশ বেড্রোসিয়ান নিশ্চিত করেন, চুক্তির প্রথম ধাপের খসড়া ‘সব পক্ষ’ স্বাক্ষর করার ৭২ ঘণ্টা পর, অর্থাৎ সোমবারের মধ্যে জীবিত ও মৃত সকল জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সার আশা প্রকাশ করেছেন, জিম্মিদের মুক্তি ‘এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে।’
তবে এই চুক্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে নিজ সরকারের মধ্যে কট্টর ডানপন্থীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গাভির ঘোষণা দেন, তিনি চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। তিনি এই চুক্তির অধীনে গাজায় অবশিষ্ট ৪৭ জন জিম্মির বিনিময়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনাকে ‘ভারী মূল্য’ বলে অভিহিত করেন। হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রথম ধাপে মুক্তি পেতে যাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দিদের তালিকায় ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এবং যুদ্ধ শুরুর পর আটক হওয়া ১ হাজার ৭০০ জনের নাম রয়েছে।
স্থায়ী সমাধান নিয়ে মতভেদ
চুক্তি ঘিরে গাজা ও ইসরায়েলে উল্লাস চলছে, বিশ্বনেতারা প্রশংসা বার্তা দিচ্ছেন, তবে এখনও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চুক্তিতে হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ এবং ট্রাম্পের নেতৃত্বে গাজার জন্য একটি অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব।
হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা ওসামা হামদান কাতারের ‘আল আরাবি’ সম্প্রচার মাধ্যমকে নিশ্চিত করেন, ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থি এই আন্দোলনটি ট্রাম্পের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, ‘কোনো ফিলিস্তিনি এটি গ্রহণ করবে না। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষসহ সকল গোষ্ঠী এটি প্রত্যাখ্যান করে।’
অন্যদিকে, ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন যে হামাসের অস্ত্র সমর্পণের বিষয়টি শান্তি পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, সেখানে ‘নিরস্ত্রীকরণ হবে’ এবং ইসরায়েলি বাহিনী ‘ধাপে ধাপে সরে আসবে’।
আন্তর্জাতিক নজরদারি
ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চুক্তির বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধানের জন্য মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপারের নেতৃত্বে ২০০ জনের একটি সামরিক দল মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হবে। এই দলে মিসরীয়, কাতারি, তুর্কি ও আমিরাতের সামরিক কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারেন।
দুই পক্ষের প্রতিক্রিয়া
এই চুক্তিকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলি চ্যানেল ১২ কে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, আজ আমরা খুবই খুশি যে রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। আমরা আশা করি এটা এভাবেই বজায় থাকবে এবং আমাদের ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে।
অপরদিকে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি সাবের জৌদেহ বলেন, ‘খবরটি শুনে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, আনন্দের অশ্রু ঝরেছে। দুই বছর ধরে বোমা হামলা, আতঙ্ক, ধ্বংস, ক্ষতি, অপমান এবং যেকোনো মুহূর্তে মারা যাওয়ার নির্ধারিত ছিল।’

ইসরায়েলে হাজার হাজার মানুষ তেল আবিবের স্কোয়ারে জড়ো হয়ে উদযাপন করেছে, যেখানে কেউ কেউ জিম্মিদের ছবি এবং ইসরায়েলি ও মার্কিন পতাকা নেড়েছেন। জিম্মি মুক্তির জন্য ৭৩৪ দিন অপেক্ষা করার পর এই চুক্তি তাদের মনে আশা জাগিয়েছে। মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ ও ট্রাম্পের জামাতা জেরেড কুশনার জিম্মি মুক্তির কাঠামো অনুমোদন করতে অনুষ্ঠিত সরকারি বৈঠকে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার রাতে জেরুজালেমে পৌঁছান।
এই চুক্তি এমন এক সময়ে হলো যখন জাতিসংঘ গাজায় চরম দুর্ভিক্ষের কথা ঘোষণা করেছে। চুক্তিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডে দ্রুত মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।