‘জীবন্ত’ কংক্রিট

দেয়ালেরও কান আছে। গোপন আলাপের সময় কথাচ্ছলেই এমনটি বলা হয়। তবে শোনার ক্ষমতা না হলেও নিজে থেকেই ক্ষয় পূরণ করতে সক্ষম এমন দেয়াল তৈরি করেছেন গবেষকরা। এর দেয়াল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ব্যাকটেরিয়াযুক্ত ‘জীবন্ত কংক্রিট’। জীবন্ত বলার কারণ হলো এই কংক্রিটে তৈরি কোনো স্থাপনার ফাটল বা সামান্য ক্ষয় নিজে থেকেই পূরণ হয়। বিশেষ ক্ষমতার এই অধিক টেকসই কংক্রিট তৈরি করেছেন নেদারল্যান্ডসের গবেষকরা।
যত সতর্কভাবেই মেশানো হোক না কেন, কংক্রিট জমাট বাঁধার পর কিছুটা ফাটল দেখা দিতেই পারে। আর কংক্রিটের স্থাপনায় ক্ষুদ্র ফাটলও ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে। কারণ এর মধ্যে পানি ঢুকে ভবনের মধ্যে চলে আসতে পারে। আবার ভবনকে দুর্বল করে দিয়ে ধসের কারণও হতে পারে ক্ষুদ্র কোনো ফাটল।
এসব বিষয় মাথায় রেখে গবেষকরা এমন কংক্রিট তৈরির কথা চিন্তা করেন, যা স্থাপনার হালকা কোনো ফাটল নিজে নিজেই ঠিক করে নিতে পারে। এই পরিকল্পনা থেকেই তৈরি হয় জীবন্ত কংক্রিট। গবেষকদের দৃষ্টিতে তাঁরা বানিয়েছেন জৈব কংক্রিট।
নেদারল্যান্ডসের ডেলফট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একদল গবেষক ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ কংক্রিট তৈরির গবেষণা করেন। এতে নেতৃত্ব দেন প্রতিষ্ঠানটির অণুজীব বিষয়ের শিক্ষক হেনক জংকার।
নিজে থেকেই ক্ষয়পূরণ করতে পারে এমন কংক্রিটের দেয়াল তৈরির গবেষণার জন্য জংকারকে অনুরোধ করেছিল ভবন নির্মাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০০৬ সাল থেকে টানা তিন বছর গবেষণার পর সমাধান পান জংকার। এর পরে চলে জৈব কংক্রিট নিয়ে পরীক্ষাগারে গবেষণা। সবশেষে বাস্তব পরিবেশে এর ক্ষয়পূরণের ক্ষমতার পরীক্ষা করা হয়।
গবেষকরা বলেন, বালু, সিমেন্ট, পাথার, পানি ইত্যাদি সাধারণভাবে কংক্রিটের যেসব উপাদান লাগে সবই থাকে জৈব কংক্রিটে। বাড়তি হিসেবে থাকে একটি ক্ষয়পূরণকারী পদার্থ। সব উপাদান মিশিয়ে কংক্রিট তৈরির সময় এই উপাদান যুক্ত করা হয়। তৈরি হয় জৈব কংক্রিট।
সাধারণ স্থাপনা ও জৈব কংক্রিটের স্থাপনার মধ্যে দৃশ্যমান কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। পার্থক্যের শুরু হয় কোনো ফাটল দেখা দিলে এবং সেখানে পানি ঢুকলে। সাধারণ কংক্রিটের স্থাপনায় ফাটল দিয়ে পানি ঢোকার পর সেখানে ড্যাম্প দেখা দেয়। তবে জৈব কংক্রিটের দেয়াল পানি পেয়ে যেন জীবন লাভ করে। এর মধ্যে থাকা বিশেষ ব্যবস্থায় যুক্ত ব্যাকটেরিয়া ও খাবার উপাদান পানি পেয়ে কার্যকর হয়। ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো ফাটলের মধ্যকার অংশ চুনাপাথর (লাইমস্টোন) দিয়ে পূরণ করে ফেলে।
গবেষক জংকার বলেন, কংক্রিটের মধ্যকার কঠিন পরিবেশে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এমন ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পাওয়াই ছিল প্রাথমিক সমস্যা। কংক্রিট হলো প্রচণ্ড অ্যালকাইল। এর মধ্যেই ক্ষয়পূরণকারী ব্যাকটেরিয়া দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হবে। হয়তো অনেক বছর পর ফাটল হওয়া ও সেখানে পানি প্রবেশ করতে পারে। ওই সময় পর একে বেঁচে উঠতে হবে।
জংকার জৈব কংক্রিটের মধ্যে বেসিলাস ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করেন। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া অ্যালকাইন পরিবেশেও দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। এমনকি অক্সিজেন ও অন্য খাবার ছাড়াই এটি কয়েক দশক বাঁচতে পারে।
শুধু ব্যাকটেরিয়া হলেই তো হবে না, একই সঙ্গে এটি দেয়ালের ফাটল পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদার্থ তৈরি করতে সক্ষম হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন খাবার। কংক্রিটের মধ্যে চিনির মতো কোনো খাবার মেশানো হলে এটি দেয়ালকে দুর্বল করে দিতে পারে। তাই খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়াম ল্যাকটেট। ব্যাকটেরিয়া ও এর খাবার দিয়ে তৈরি করা হয় একধরনের ক্যাপসুল। এই ক্যাপসুলের আবরণ তৈরি হয়ে প্রকৃতিতে মিশে যায় জৈব পদার্থ দিয়ে। মোটা ডালের মতো দেখতে ওই ক্যাপসুলগুলো কংক্রিট তৈরির সময় সিমেন্ট, বালুসহ অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
গবেষকরা আশা করছেন, জৈব কংক্রিটে তৈরি ক্ষয়পূরণের ক্ষমতাসম্পন্ন স্থাপনা তৈরির শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
গবেষক জংকারের মতে, জৈব কংক্রিটে তৈরি স্থাপনা হলো প্রকৃতি ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন। প্রকৃতিই মানুষকে বিনে পয়সায়ই এমন ব্যাকটেরিয়া দিয়েছে, যা দেয়ালের ফাটল পূরণে সক্ষম। গবেষকরা শুধু এর প্রয়োগের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।