জাপানে করোনায় মৃত্যুর হার এত কম যে কারণে

জাপানে নভেল করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা এত কম কেন? মৃত্যু নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন খারাপ শোনালেও, এ নিয়ে এখন নানা তত্ত্ব আলোচনায় উঠে আসছে। কেউ বলছে, এর পেছনে রয়েছে জাপানিদের মন-মানসিকতা, তাদের সংস্কৃতি; আবার কারো মত হলো জাপানীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অসাধারণ। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
জাপানের বিশেষত্ব কোথায়?
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী তারো আসো মনে করেন, জাপানিদের ‘আদর্শ আচরণের’ কারণে দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর হার কম। তিনি বলেন, জাপানের সাফল্যের কারণ নিয়ে অন্য দেশের নেতারা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর উত্তরকে অনেকেই অবশ্য কিছুটা তির্যক মনে করেন।
তারো আসো বলেন, “আমি তাদের বলেছিলাম, ‘আপনার এবং আমার দেশের মানুষের আচরণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে’। তারা শুনে চুপ করে গিয়েছিলেন।”
তারো আসো এ ক্ষেত্রে যে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সেটা হলো ‘মিন্ডো’। তিনি বলেছিলেন তফাৎটা ‘মিন্ডোতে’। মিন্ডোর আক্ষরিক অর্থ ‘মানুষের মান’। যদিও অনেকে বলছেন, তারো আসো সংস্কৃতিগত মানের কথা বলেছেন।
ঐতিহাসিকভাবে জাপানিরা মনে করে, জাতি হিসেবে তারা উঁচ্চমানের এবং সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের বিষয়টিও তাদের মজ্জাগত। তবে তারো আসো তাঁর এমন মন্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছেন।
তবে তারো আসোর মন্তব্যের বিষয়টি বাদ দিলেও জাপানের বহু মানুষ এবং অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন, জাপানের ক্ষেত্রে একটা কিছু আছে যা আর সবার থেকে আলাদা। একটা কিছু যা কোভিড-১৯ থেকে জাপানের মানুষকে রক্ষা করেছে।
জাপানের মানুষ ১৯১৯ সালের ফ্লু মহামারির পর থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফেস মাস্ক পরা শুরু করেছে। তারা একশ বছরের এ অভ্যাস এখনো ছাড়েনি। জাপানে কারো কাশি হলে বা ঠাণ্ডা লাগলে, সে অন্যদের সুরক্ষিত করতে সবসময় মাস্ক পরে।
হংকং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের পরিচালক এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ কেইজি ফুকুদা বলেন, ‘মাস্ক সংক্রামক ভাইরাস সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন রাখার একটা খুবই ভালো হাতিয়ার।‘’
জাপানের ট্র্যাক ও ট্রেস ব্যবস্থা অর্থাৎ সংক্রমিতকে খুঁজে বের করে তার সংস্পর্শে কারা এসেছে, সেটা নজরে রাখার ব্যবস্থাও বহু পুরনো। ১৯৫০-এর দশকে জাপান যখন যক্ষ্মা রোগের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন তারা এ ব্যবস্থা চালু করে।
জাপান সরকার নতুন কোনো জীবাণুর সংক্রমণের খবর এলে আক্রান্তদের চিহ্ণিত করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেছিল। তাদের কাজ যেকোনো নতুন সংক্রমণের খবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো।
গোড়াতেই সতর্কতা
করোনা মহামারির বেশ শুরুর দিকে জাপান দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করেছিল। তারা দেখেছিল, একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং তারা একই ধরনের জায়গায় যায়।
কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষক ড. কাজুয়াকি জিন্দাই বলেন, ‘আমরা দেখেছিলাম, বেশিরভাগ আক্রান্ত মানুষ গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখানে জোরে জোরে গান গাওয়া হয়, হৈচৈ চিৎকার হয়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলি, এ ধরনের জায়গায় যাওয়া বন্ধ করতে হবে।’
ড. কাজুয়াকি জিন্দাইর সহকর্মীরা দেখেন ‘কারাওকি’ ধাঁচের গানের জলসা, পার্টি বা ক্লাবে হৈচৈ চিৎকার করে আনন্দ উল্লাস, পানশালায় গালগল্প এবং শরীর চর্চা কেন্দ্রে ব্যায়াম — যেখানে মানুষ পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসে, মেলামেশা করে, জোরে কথা বলে এবং জোরে নিশ্বাস নেয় — সেসব জায়গায় ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি খুব বেশি।
দ্বিতীয়ত, গবেষকরা দেখেন যে যারা আক্রান্ত, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। ‘সার্স কোভি-২’ যখন হয়, তখন গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভাইরাস ছড়ায় না। তবে, তাদের মাত্র ২০ শতাংশ খুবই সংক্রামক হয়।
জাপান জরুরি অবস্থা জারি করলেও ঘরে থাকা বাধ্যতামূলক করেনি, তবে মানুষকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করেছে —
এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকার জাতীয় পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালায় এবং বলে তিনটি ব্যাপার যেন তারা এড়িয়ে চলে— এক. বদ্ধ জায়গা যেখানে বাতাস চলাচল ভালো নয়, দুই. জনবহুল স্থান এবং তিন. খোলা নয় এমন জায়গায় মুখোমুখি বসে গল্প করা।
ড. জিন্দাই বলেন, ‘আমার মনে হয় মানুষকে ঘরবন্দি না করে, এমন পরামর্শ দেওয়া কাজে দিয়েছে।’
মানুষ তাতে সতর্ক হয়েছে, সংক্রমণ এড়িয়েছে এবং সংক্রমণ কম হওয়ার কারণে মৃত্যুও হয়েছে কম। যদিও মার্চের মাঝামাঝি টোকিওতে হঠাৎ করে সংক্রমণ বাড়ার ঘটনা ঘটেছিল।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত ৭ এপ্রিল দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। তবে ঘরে থাকা তিনি বাধ্যতামূলক করেননি। শুধু মানুষকে বলেছিলেন, ‘সম্ভব হলে ঘর থেকে বেরোবেন না।’
হৃদরোগ, স্থুলতা ও ডায়াবেটিস কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ভয়ের কারণ। জাপানে হৃদযন্ত্রের অসুখ খুবই কম। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে হদরোগ এবং স্থুলতার সমস্যা সবচেয়ে কম।
তবে অধ্যাপক ফুকুদা বলছেন, জাপানে মৃত্যুর হার যে এত কম, তার পেছনে এগুলোই যে কারণ, জোর গলায় এমন কথা বলা যাবে না। এর পেছনে আরো অন্য কারণ থাকাও সম্ভব।
জাপানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো, সেখানকার মানুষের মধ্যে নির্দেশ মানার সংস্কৃতি। সরকার জানে তারা জনগণকে কিছু বললে, জনগণ তা শুনবে ও মানবে।
জাপানের সরকার মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়নি, ‘ঘরে থাকা ভালো’ বলে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু জনগণ ঘরে থেকেছে।
অধ্যাপক শিবুয়া বলেন, ‘এটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। জাপানে মানুষকে ঘরে থাকতে বলাটা বাস্তবে লকডাউনের চেহারা নিয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধ জারি না করেই সরকার জনগণের সহযোগিতা পেয়েছে।’
জাপান সরকার জনগণকে বলেছে, নিজের যত্ন নিন, ভিড় পরিহার করুন, মাস্ক পরুন, হাত ধোন। জাপানের জনগণ অক্ষরে অক্ষরে সবগুলো পরামর্শ নিজেদের স্বার্থেই মেনে চলেছে।