গাজায় খাদ্য সংকট চরমে, অনাহারে ধুঁকছে শিশুরা

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। হাজার হাজার শিশু ও নারী তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। সংকট তৈরি হয়েছে জরুরি চিকিৎসাসেবায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অবরুদ্ধ এই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবিক সাহায্য ঢুকছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। খবর এএফপির।
গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানিয়েছে, তারা নবজাতক শিশুদের মধ্যে তীব্র ক্ষুধা ও অপুষ্টি জনিত মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছে। গত এক সপ্তাহে অন্তত তিনটি শিশুর এমন হৃদয়বিদারক মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেছেন, এই মৃত্যুগুলো সরাসরি বোমাবর্ষণের কারণে নয়, বরং অনাহার, শিশুর দুধের অভাব ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অভাবে ঘটেছে।
গাজার উত্তর থেকে নুসেইরাত শহরে আশ্রয় নেওয়া ৪৫ বছর বয়সী জিয়াদ মুসলেহ এএফপিকে বলেন, আমরা মারা যাচ্ছি, আমাদের সন্তানরা মারা যাচ্ছে। আমরা এটা থামাতে কিছুই করতে পারছি না। তিনি আরও যোগ করেন, আমাদের শিশুরা খাবারের জন্য কাঁদে আর চিৎকার করে। তারা খালি পেটে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘুমায়। খাবার একদমই নেই। আর যদি সামান্য কিছু বাজারে আসেও, তার দাম এত বেশি যে কেউ কিনতে পারে না।
রোববার নুসেইরাতের একটি জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বিতরণের সময় শিশুদের ক্ষুধার্ত চেহারা দেখা যায়। তাদের অনেকে প্লেটে আঘাত করে নিজেদের মন ভালো রাখার চেষ্টা করছিল। খাবার অপেক্ষায় থাকা উম্ম সামেহ আবু জেইনা জানান, আমরা যথেষ্ট খাই না। আমি আমার মেয়ের জন্য খাবার রাখি, আমি নিজে খাই না।
খাদ্যমূল্য আকাশছোঁয়া, সাহায্য পৌঁছানো কঠিন
গাজার বাসিন্দারা ও সাহায্য সংস্থাগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে, মজুত কমে যাওয়ায় বাজারে সামান্য যে খাবার পাওয়া যাচ্ছে তার দাম আকাশছোঁয়া। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিওএফপি) জুলাইয়ের শুরুতে সতর্ক করেছিল, রুটির জন্য ময়দার দাম ২১ মাস আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের চেয়ে তিন হাজার গুণ বেশি।
ডব্লিউএফপি পরিচালক কার্ল স্কাউ জুলাইয়ের শুরুতে গাজা সিটি পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি পরিস্থিতিকে ‘তার দেখা সবচেয়ে খারাপ’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে দেখা করা একজন বাবা গত দুই মাসে ২৫ কেজি ওজন কমিয়েছেন। মানুষ অনাহারে আছে, অথচ আমাদের কাছে সীমান্তের ওপারেই খাবার মজুত আছে।
মার্চে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েল গাজার ওপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। ফলে মে মাসের শেষ পর্যন্ত খুব সামান্যই সাহায্য প্রবেশ করতে পারে। যুদ্ধবিরতির সময় জমা হওয়া মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় ফিলিস্তিনি অঞ্চলে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। স্কাউ বলেন, আমাদের রান্নাঘর খালি; সেখানে এখন সামান্য পাস্তা মিশিয়ে গরম পানি দেওয়া হচ্ছে।

শিশুদের ওপর অপুষ্টির ভয়াবহ প্রভাব
শিশুদের ও গর্ভবতী নারীদের ওপর অপুষ্টির প্রভাব বিশেষভাবে মারাত্মক। মেডিকেল চ্যারিটি ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) গত সপ্তাহে জানিয়েছে, গাজায় তাদের দল অপুষ্টির যে পরিমাণ কেস দেখছে, তা তাদের রেকর্ড করা সর্বোচ্চ সংখ্যা।
এমএসএফ-এর গাজার ডাক্তার জোয়ান পেরি বলেন, গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ব্যাপক অপুষ্টি এবং খারাপ পানি ও স্যানিটেশন অবস্থার কারণে অনেক শিশু অকালে জন্মগ্রহণ করছে। তিনি আরও যোগ করেন, আমাদের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট মারাত্মকভাবে জনাকীর্ণ, যেখানে চারটি থেকে পাঁচটি শিশু একটি ইনকিউবেটরে রয়েছে।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের ১০ বছর বয়সী আমিনা ওয়াফি জানায়, সে সব সময় খাবারের কথা ভাবে। সে এএফপিকে বলে, আমি সব সময় ক্ষুধার্ত থাকি। আমি সবসময় আমার বাবাকে বলি, ‘আমি খাবার চাই’, আর তিনি আমাকে কিছু আনার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কিছুই থাকে না, তিনি সহজভাবে আনতে পারেন না।
এমএসএফ আরও জানায়, তাদের ক্লিনিকগুলোতে প্রোটিনের অভাবে রোগীরা ক্ষত থেকে দ্রুত সুস্থ হতে পারছে না। খাদ্যের অভাবে সংক্রমণ সুস্থ ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি দিন স্থায়ী হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে এক হাজার ২১৯ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
অন্যদিকে হামাস-পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে— ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৮ হাজার ৮৯৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এছাড়া আরও এক লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৪ জন আহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।