প্রথম উপন্যাসের অসন্তুষ্টি থেকে নোবেল বিজয়ী লাসলো

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। এবারের নোবেল বিজয়ী এই লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘সাটানতাংগো’ (Satantango) ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। বন্ধু লেখক পিটার এসতেরহাজির উৎসাহেই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই উপন্যাস প্রকাশের পর লাসলো নিজেকে লেখক ভাবতে চাননি। বইটি নিয়ে অসন্তুষ্টি থেকেই তিনি শুরু করেন পরবর্তী উপন্যাস ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিসট্যান্স (The Melancholy of Resistance)’। প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর তাকে আর থেমে থাকতে হয়িনি।
এ প্রসঙ্গে লাসলো বলেন, ‘আমি আবার চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, হয়তো এবার ঠিক হবে। এরপর থেকে আর থামতে পারিনি।’
কে এই লাসলো?
লাসলো ক্রাসনাহোর্কাইয়ের জন্ম ১৯৫৪ সালে। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আরও যেগুলো আছে তার মধ্যে ‘অয়ার অ্যান্ড অয়ার (War and War)’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে এবং ‘ব্যারন ভেন্খাইম্স হোমকামিং Baron Wenckheim’s Homecoming) প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে।
নোবেল বিজয়ী লাসলো দীর্ঘদিন ধরে হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা বেলা টারের (Béla Tarr) সঙ্গে কাজ করেছেন—যিনি তার বেশ কিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেছেন। লাসলো ক্রাসনাহোরকাই পেয়েছেন বহু সম্মাননা। এরমধ্যে ২০১৫ সালের ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার, ২০১৯ সালের ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার এবং হাঙ্গেরির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘কোসুথ পুরস্কার’ উল্লেখযোগ্য।
খ্যাতনামা লেখিকা সুজান সনটাগ (Susan Sontag) তাকে বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘অ্যাপোক্যালিপসের সমসাময়িক হাঙ্গেরীয় গুরু, যার মধ্যে গোগোল ও মেলভিলের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়।’
লাসলোর বিশেষ সাক্ষাৎকার
জোহান লোস (Johan Lose) ২০১৯ সালের আগস্টে ডেনমার্কের হুমলেবেকে অবস্থিত লুইজিয়ানা মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে অনুষ্ঠিত ‘লাইজিয়ানা লিটারেচার ফেস্টিভাল’-এর প্রেক্ষিতে একটি সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই বলেন, আমি জিউলাকে এমন এক কিংবদন্তির বই হিসেবে দেখি, যেখানে আসলে কিছুই সত্য নয়—তবু সবকিছুই সত্য হতে পারত। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও যেসব কথা জানান—
আমি জানি, ওই মানুষগুলো সেখানে ছিল, কিন্তু আর কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। সত্যি বলতে, আমি প্রমাণ করার চেষ্টাও করি না।
আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন সেখানে একটি রোমা বসতি ছিল। ওই বসতিতে তারা হাঙ্গেরিয়দের থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আলাদা জীবনযাপন করত। কিন্তু যখন আমি সেখানে পৌঁছাই, একটি নতুন পরিকল্পনার রাস্তা তৈরি হয়েছিল—রোমা গৃহগুলো ধ্বংস করে দেওয়া এবং তাদের হাঙ্গেরিয়দের মধ্যে স্থানান্তর করা। এক রোমা পরিবার, এক হাঙ্গেরীয় পরিবার, এক রোমা, এক হাঙ্গেরীয়। ভাবতে পারেন, সেখানে কী ঘটেছিল? কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এমন তীব্র ঘৃণা জন্ম নিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি এসবকিছু ১৯ বছর বয়সে সরাসরি দেখেছি, তেমন মনোযোগ দিতে পারিনি।
যেমনভাবে জীবন ও প্রকৃতির সবকিছুর চূড়ান্ত অবস্থা হলো ধ্বংস। একটি পিপড়ে মারা যায়, একজন মানুষ মারা যায়, একটি গাছ শুকিয়ে যায়, একটি যন্ত্র নষ্ট হয়—সবকিছুরই একই গন্তব্য। এই বাস্তবতা ছাড়া বিশ্বের অবস্থার প্রকৃতি বোঝানো সম্ভব নয়। তাই এটি অবিচ্ছেদ্য। আমি সেই কাজগুলোকে ভারসাম্যহীন মনে করতাম, যা এই মৌলিক প্রশ্ন স্পর্শও করে না।
আমি মনে করি, মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় না—অপোক্যালিপসিসের জন্য। আমরা যে জীবনে বাস করি, সেটাই এক ধরনের অপোক্যালিপসিস। অতএব, অপেক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি কোনো সতর্কবার্তা বা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক চেতনা নয়।
নায়কদের অভ্যন্তরীণ দিকও ঠিক তেমন—তারা আশা ছাড়া অস্তিত্বমান। মানুষরা যে বিষয়ে বিলম্ব করে, তা হলো বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া—নিজের বাস্তবতার অথবা সমাজে যে চূড়ান্ত পরিস্থিতি আসছে তার।
অতএব, আমি মূলত সেই মানুষকে চিত্রিত করি যে আশা ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাকে বলা যে, আগামীকাল সূর্য উঠবে—যেমন হুমলেবেকে—যদিও এটি শিল্পীর কাজ নয়। কারও ভয় নয়, মানুষ এটি করতে পারে। যারা এইভাবে খেলছে, তাদের আমরা সাধারণত রাজনীতিবিদ বা অনুরূপ দুষ্টলোক বলি। আমি আগে বলেছিলাম, রাজনীতিবিদরা দুষ্ট লোকের মতো। এখানে আরও সঠিকভাবে বলা যায়, রাজনীতিবিদরা হলেন অনুধাবনহীন দুষ্টলোক।