মারিয়া কোরিনা মাচাদো : লৌহমানবের বিরুদ্ধে এক অগ্নিশিখা

মারিয়া কোরিনা মাচাদো–ভেনেজুয়েলার লৌহমানব হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কঠোর শাসনের বিরুদ্ধাচারণ করা বিরোধী দলের একজন নির্ভীক কর্মী, যিনি রকস্টারের মতো আবেদন নিয়ে চষে বেড়ান দেশের আনাচে-কানাচে। দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক সিমোন ‘দ্য লিবারেটর’ বলিভারের প্রতি সম্মান রেখে তাকে ‘লা লিবারতাদোরা’ বা ‘মুক্তির নেত্রী’ হিসেবেও ডাকা হয়। ভেনেজুয়েলায় একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রচেষ্টায় অবদানের জন্য সেই মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে আজ শুক্রবার ‘নোবেল শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়েছে। খবর এএফপির।
২০২৪ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাদুরোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বিরত রাখার জন্য মাচাদোকে আটক করা হয় ও পরে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকীতে এ বছরের জুলাই মাসে তিনি মাদুরোর বিরুদ্ধে ‘গাপন প্রতিরোধের’ ডাক দেন। ওই সময়টাকে বেশ কয়েক সপ্তাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পালিয়ে বেড়ানো মাচাদো সম্পর্কে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন।
জনপ্রিয়তার বিচারে এই মুহূর্তে ভেনেজুয়েলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ মাচাদো। তবে তিনি নেপথ্যে থেকে কাজ চালিয়ে যেতেন। গত বছরের নির্বাচনে সাবেক কূটনীতিক এডমান্দো গনজালেজ উরুটিয়া শেষ মুহূর্তে তার পরিবর্তে বিরোধী দলের প্রার্থী মনোনীত হলে তিনি তার পক্ষে প্রচারণায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
২০২৩ সালের বিরোধী দলের প্রাইমারিতে মাচাদো ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা দেখে মাদুরোর অনুগত কর্তৃপক্ষ তাকে নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে। তবে গনজালেজ উরুটিয়ার ‘দ্বিধাগ্রস্থ’ প্রার্থীতা তিনি মেনে নিয়েছিলেন এবং খুব দ্রুত তাকে আলোচনার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসেন।
মাচাদো সবসময় সাদা পোশাক পরেন এবং সমর্থকদের শ্রদ্ধাভরে উপহার দেওয়া জপমালা তার গলায় থাকে। জনসমাবেশে তিনি যেন এক রকস্টার। তাকে দেখলেই লোকজন শিশুদের কোলে তুলে সামনে এগিয়ে ধরে, উপহার দেয় ফুল বা বেসবল ক্যাপ। জনসভাগুলোতে তারা ‘সি, সে পুয়েদে’ বা ‘হ্যা, আমরা পারি’ বলে শ্লোগান দেয়, কাছে আসার চেষ্টা করে, সেলফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলে, হাতে ওড়ায় ভেনেজুয়েলার পতাকা।
যে উদ্যম আর উদ্দীপনা মাচাদো সৃষ্টি করেছিলেন নাগরিকদের মাঝে তা কাজে আসেনি নির্বাচনে, কেননা মাদুরো নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বেশকিছু দেশ গনজালেজ উরুটিয়াকেই ভেনেজুয়েলার ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
মাচাদোর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘোষণা এমন সময়ে এলো যখন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির উপকূলের আন্তর্জাতিক জলসীমায় একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে মাদক চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে চলছে এই অভিযান। এসব হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওয়াশিংটন মাদুরোকে মাদকচক্রের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করে আসছে এবং তারা মাদুরোকে বৈধ নেতা হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় না।
গত মাসে একটি ভিডিওতে মাচাদো এবং উরুটিয়া মার্কিন সামরিক চাপকে দেশটির সার্বভৌমত্ব পুনুরুদ্ধারে ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তারা মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে মাদক, খনিজ, ধাতু, অস্ত্র এবং মানবপাচারসহ অন্যান্য অনেক অপরাধের অভিযোগ আনেন।

গত বছরের নির্বাচনে পরাজয়ের পর হুমকির শিকার হয়ে স্পেনে নির্বাসিত গনজালেজ উরুটিয়ার চেয়ে ভিন্ন পথে হাঁটেন মাচাদো। আত্মগোপনে থেকে প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য তিনি ভেনেজুয়েলাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি ‘ছদ্মবেশের কৌশল’ অবলম্বন করেন। হঠাৎ করেই তিনি কোনো রাস্তার কোনায় ট্রাকের পিছনে আবির্ভূত হন আর বক্তৃতা দেওয়া শেষ হতে না হতেই মোটরসাইকেলের পিছনে চড়ে পালিয়ে যান।
পেশায় প্রকৌশলী মারিনা কোরিনা মাচাদো ২০০২ সালে ‘সুমাতে’ নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন। এই সুমাতে (যার অর্থ আমাদের সাথে যোগ দিন) মাদুরোর পূর্বসূরী সমাজতান্ত্রিক নেতা হুগো শাভেজের বিরুদ্ধে গণভোটের দাবি জানিয়েছিল।
নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি না থাকার পরেও মাচাদোকে ২০২৩ সালে বিমানে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ সময় তিনি সড়কপথে দেশ চষে বেড়ান এবং নির্বাচনে গনজালেজ উরুটিয়ার পক্ষে দেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করেন। মানুষকে তাকে সাদরে গ্রহণ করে।
মাচাদো তার প্রচারণায় নিপীড়নমূলক সমাজতান্ত্রিক শাসনের অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক ভেনেজুয়েলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে এক সময়ের খনিজতেল সমৃদ্ধ এই দেশটির ৭০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে অনত্র পাড়ি দিয়েছে।
মারিয়া কোরিনা মাচাদো অঙ্গীকার করে বলেছেন, আমরা দেশকে মুক্ত করব এবং আমাদের দেশের সন্তানদের ফিরিয়ে আনব।