রুপালি গিটার ফেলে আইয়ুব বাচ্চুর এক বছর
ব্যান্ড সংগীতের সাম্রাজ্য আছে। তবে নেই চাকচিক্য। ফিকে হয়েছে দেয়ালের রং। কারণ, শারীরিকভাবে বেঁচে নেই গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। তবে সুরপিয়াসীদের মনে তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল। বেঁচে থাকবে তাঁর কথা, সুর ও কণ্ঠ।
নব্বই দশকজুড়ে ব্যান্ড সংগীতজগতের সে কী রমরমা অবস্থা। সেই ক্যাসেট-ফিতার যুগে একটি মিক্সড অ্যালবাম বের হলেই লেগে থাকত দোকানগুলোতে ভিড়। একসঙ্গে উচ্চারিত হতো তিনটি নাম—আইয়ুব বাচ্চু-জেমস-হাসান। তাঁদের ফ্যাশনও অনুকরণ করত তরুণ তুর্কিরা। জিন্স, টি-শার্ট, চোখে চশমা, লম্বা চুলের তরুণদের তিন ক্রেজ।
‘এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে’—গেয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু সত্যিই যে গত বছরের ১৮ অক্টোবর হুট করে চলে যাবেন, স্বপ্নেও ভাবেননি কেউ। আজও অনেকের বিশ্বাস, তিনি বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন। ভক্তহৃদয় বলে কথা!
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে সমস্ত স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে জেমসের মনে। তবে রুপালি গিটার হাতের সেই মানুষটি নেই। তাঁকে ছাড়া একাকিত্বে ভুগছেন। আইয়ুব বাচ্চুকে ছাড়া ব্যান্ড সংগীতের ভুবনে শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন জেমস। এই তারকা বলেন, ‘বাচ্চু ভাইকে ছাড়া ব্যান্ড সংগীতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কখনোই আর পূরণ হবে না।’
সে সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল আর্কের ভোকাল হাসান তো আজও বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি নেই। যখন তিনি টের পান সত্যিই আইয়ুব বাচ্চু নেই, তখন হোঁচট খান। বেদনায় ভরে ওঠে বুক।
ব্যান্ড জগতের তারকা হাসানের ভাষায়, ‘আমি এখনো হোঁচট খাই, যখন বুঝতে পারি আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। এটা খুবই বেদনাদায়ক। তিনি ছিলেন আমার প্রকৃত অভিভাবক। তিনি নেই, এটা বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হয়।’
১২ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রিয় শিল্পীকে হারানোর শোকে এখনো কাঁদছেন স্বজন, ভক্ত, অনুরাগী ও সংগীত-পরিবারের সবাই। কেউই তাঁকে ভুলতে পারেননি। কেউ কেউ ভাবছেন, হয়তো তিনি আছেন—দূরে কোথাও। নীরবে কাঁদছে আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের তারও!
প্রিয় শিল্পীকে স্মরণ করে সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু হয়নি, তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন। এই মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারিনি।’
গানের মতোই আকাশে উড়াল দেওয়া আইয়ুব বাচ্চু আছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নকিব খানের হৃদয়ে। ‘বাচ্চু নেই, এটা খুব কষ্টের ব্যাপার। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চু চলে যাবে, ভাবতেও পারিনি। আর কীভাবে যে এক বছর কেটে গেল, সেটাও বুঝতেই পারছি না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন রেনেসাঁ ব্যান্ডের এ তারকা।
কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের তো এই এক বছর কেটেছে বন্ধুহীন, আড্ডাহীন, নিঃসঙ্গ।
এ সংগীততারকা বলেন, ‘বন্ধুহীন এক বছর কেটেছে আমার। আমি তো বিশ্বাস করতে চাই না যে আমার বন্ধু নেই, আর কোনো দিনই দেখা হবে না। হয়তো সে আছে আমার আশপাশে, কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে না। কিন্তু সে আছে। থাকতেই হবে। এ কারণে খুব যত্ন করে তাঁর সব স্মৃতি যেমন আমি আমার মনের ঝুড়িতে জমিয়ে রেখেছি, ঠিক তেমনি ফোন নাম্বারটাও ডিলিট করিনি।’
নতুন প্রজন্মের গায়কদের হৃদয়েও চিরকালীন আসন বাচ্চুর। তাঁর সঙ্গে রয়েছে কত স্মৃতি। কণ্ঠশিল্পী ঐশী বলেন, ‘বস শেষ কনসার্ট করেছিলেন রংপুরে। ওই কনসার্টে আমিও ছিলাম। বসের সঙ্গে সেলফি তুলেছি। সংগীত নিয়ে আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন তিনি। বসকে কখনো ভুলব না।’
গান ছিল আইয়ুব বাচ্চুর অন্তরের ভাষা। গানকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। গায়ক থেকে হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত শিল্পী। বিভিন্ন সময় এ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী কোনালকেও নানা পরামর্শ দিয়েছেন।
‘বাচ্চু ভাই আজীবন বলেছেন, নিজের গানগুলোকে খুব যত্ন করে এক এক করে বাড়াতে হবে, করতে হবে, সুন্দর করে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে হবে। গানের সঙ্গে কখনো বেইমানি করা যাবে না,’ বলেন কোনাল।
আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে তৈরি হয়েছে রুপালি গিটারের ভাস্কর্য। দূর থেকে সেই ভাস্কর্য দেখে মনে হবে আইয়ুব বাচ্চু আছেন, থাকবেন। তাঁর সুরের মৃত্যু নেই। কণ্ঠের মৃত্যু নেই।