দীর্ঘমেয়াদি কিডনির রোগ কেন হয়?
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি রোগ অনেকেরই হয়। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে ক্রনিক কিডনি রোগ প্রতিহত করা যায়।
৮ ফেব্রুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৯১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. তানভির বিন লতিফ। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে নেফ্রোলজি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : কিডনির বিভিন্ন রকম সমস্যা হয়। এর মধ্যে একটি প্রচলিত সমস্যা হচ্ছে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। যদি একটু বুঝিয়ে বলেন ক্রনিক কিডনি ডিজিজ মানে কী? এটি কাদের বেলায় বেশি হয়?
উত্তর : সারা পৃথিবীতে যদি আমরা দেখি, ক্রনিক কিডনি রোগের প্রধান কারণ তিনটি। এক নম্বর কারণ হলো, ডায়াবেটিস। দুই নম্বর কারণ হলো, উচ্চ রক্তচাপ, যাকে আমরা হাইপার টেনশন বলি। আরেকটি হলো, গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস বা কিডনির প্রদাহ। এই তিনটি কারণেই সাধারণত ক্রনিক কিডনি রোগ হয়। ক্রনিক কিডনি ডিজিজকে বলা যেতে পারে ‘কিডনির দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ’।
এটি যখন একবার শুরু হয়, তখন সেটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিডনির ক্ষতি হতেই থাকে। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে একে পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব না হলেও ধীর বা স্লো করা যায়। বা এর ক্ষতিকর প্রভাবকে অনেকটা ঠেকিয়ে রাখা যায়। সুতরাং এর চিকিৎসা রয়েছে।urgentPhoto
প্রশ্ন : এর মানে হলো এই তিনটি রোগ যাদের রয়েছে তারা ঝুঁকিপ্রবণ। এর বাইরেও জীবনযাপনের ধরন, খাবারদাবার- এগুলো কি কোনো ভূমিকা রাখে?
উত্তর : আমি বলব, পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। খাবারদাবারের সঙ্গে, জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ হাঁটাচলা করছে না, ব্যায়াম করছে না, মানুষ বসে থাকছে টিভির সামনে। এই কারণে মানুষের ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা হয়। সেখান থেকে ডায়াবেটিস হয়, উচ্চ রক্তচাপ হয়। সেইখান থেকে শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে কিন্তু কিডনির রোগগুলো হয়। সুতরাং আপনি একভাবে হয়তো বলতেই পারেন, আমাদের জীবনাচরণের সঙ্গে কিডনির রোগের সম্পর্ক আছে।
এ ছাড়া আরেকটি বিষয়কে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি আমি। সেটি হচ্ছে, ওষুধপত্রের ব্যবহার। আপনি জানেন প্রচুর ওষুধ অপ্রয়োজনে ফার্মেসি থেকে কিনে খাওয়া হয়। অনেকেই যখন-তখন ওষুধ খায়। হয়তো সেই ওষুধের দরকার নেই সেই সময়।
অনেক সময় দেখা যায়, অল্পস্বল্প ব্যথাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে রোগী ব্যথার ওষুধ খায়। এতে দেখা গেল যে কিডনির রোগ শুরু হয়ে গেছে। আমরা মনে হয়, এই ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া জরুরি। এর মাধ্যমে আমরা একটা ব্ড় দলকে কিডনি রোগ হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে পারি।
প্রশ্ন : একিউট কিডনি ইনজুরি (হঠাৎ কিডনি অকেজো) থেকেও কি দীর্ঘমেয়াদি কিডনির সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : হ্যাঁ, হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার নানা কারণ রয়েছে। যেমন : ডায়রিয়া হলে পানিশূন্যতা হয়। শরীর থেকে যদি অনেক পানি চলে যায় বা কোনো কারণে যদি রক্তচাপ কমে যায়, তখনো কিন্তু কিডনি সাময়িকভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে আপনি যদি খুব তাড়াতাড়ি যথাযথ চিকিৎসা দেন, তাহলে এই কিডনি আবার ভালো অবস্থানে ফিরে আসে। তবে যদি সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা না দেওয়া হয়, অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে, তাহলে পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। তখন সেটিও ক্রনিক কিডনি রোগের একটি কারণে পরিণত হয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি একিউট কিডনি ডিজিজও ক্রনিক কিডনি রোগের একটি কারণ।
প্রশ্ন : আমরা ইদানীং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বা প্রচারণায় শুনতে পাই, খাদ্যে ভেজাল। কিডনি রোগের যে মাত্রা বাড়ছে, এতে কি এর কোনো প্রভাব রয়েছে?
উত্তর : এটি নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। গবেষণা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে আমরা সাধারণভাবে চিন্তা করলেও দেখতে পারি, মানুষের শরীর তৈরি হয়েছে খাবার খাওয়ার জন্য। এখন সেই খাবারের মধ্যে যদি ফরমালিন বা কীটনাশক থাকে, সব খাবারই কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিডনি দিয়ে যাবে। কারণ কিডনি রক্ত, সবকিছু ধুয়ে ফেলে। সুতরাং কিডনি দিয়ে এ সমস্ত পদার্থ যদি যায়, এগুলো কিডনির মধ্যে সূক্ষ্ম অঙ্গগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। শেষ পর্যন্ত কোন উপাদানটি আসলে সমস্যা তৈরি করছে, সেটি হয়তো আমরা জানি না। তবে আমরা ধারণা করতে পারি, এটি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। সুতরাং আমরা মনে হয় এই বিষয়েও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : ক্রনিক কিডনি ডিজিজে সাধারণত কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : কিডনি রোগের ক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে অসুবিধাজনক, সেটি হলো অসুবিধা যখন বড় আকারে দেখা দিল, তখন কিন্তু রোগটি অগ্রসর হয়ে গেছে। মানে কিডনি অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।
এখন প্রতিরোধ করার জন্য আপনি কী করতে পারেন? হয়তো আপনি জানেন আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে বা আপনার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সুতরাং রোগীর নিজের লক্ষ্য নিজের জানতে হবে। আমাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা রোগীদের বলি, খালি পেটে আপনার ডায়াবেটিস সাতের নিচে থাকতে হবে। আর ভরা পেটে, মানে নাশতার দুই ঘণ্টা পরে নয়ের নিচে থাকতে হবে। এটা যদি সে সচেতনভাবে করে, তাহলে তার কিডনির রোগ কমে যাবে। এবং যদি হয়েও থাকে, এটি বাড়বে না।
উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমরা বলি, সব সময় রক্তচাপ, ওপরেরটা ১৪০ এবং নিচেরটা ৮০ থাকতে হবে। এ রকম রাখা গেলে আপনার ক্রনিক কিডনি রোগ হয়ে গেলেও এর বৃদ্ধিকে কমাতে পারবেন। যাঁদের হয়নি, তাদের হওয়ার ঝুঁকিও কমে যাবে। রোগী যদি সচেতন থাকেন, তাহলে প্রতিরোধ করা সহজ হয়।
প্রশ্ন : যদি সমস্যা হয়ে যায়, যখন লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তার কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : সাধারণত পায়ে পানি আসে। পা একটু ফুলে যায়। যদিও পা ফুলে যাওয়ার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে কিডনি রোগ হলেও পা ফুলে যায়। মুখ ফুলে যেতে পারে। রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। যেমন করে পায়ে পানি জমে যায়, তেমনি ফুসফুসেরও পানি জমে যায়। রোগী শুতে পারে না, কাশি হয়। তার রক্তচাপ অনেক বাড়তে থাকে। তার প্রস্রাবের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। দেখা যায় প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন হচ্ছে। এসব লক্ষণ দেখে বোঝা যায় রোগীর কিডনি রোগ হওয়ার আশঙ্কা আছে। তখন আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হই।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততদিনে কিডনি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। তার কার্যক্ষমতা অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে ওই অবস্থায় ধরা পড়লে উপায় কী? এটা কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য? কিডনি কি আগের অবস্থায় কার্যক্ষম হবে?
উত্তর : শতকরা ১০০ ভাগ ক্ষেত্রে সেটি আসলে হবে না। প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলে রোগটি আর অগ্রসর হবে না। তবে অন্যান্য যেসব উপসর্গ হতো, যেমন আপনার শরীরে পানি জমে গেছে, সেটি বের করে দেওয়ার ওষুধ রয়েছে। আপনার ফুসফুসে অতিরিক্ত পানি জমে গেছে, সেটি বের করে দেওয়ার উপায় রয়েছে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো যদি করা যায় তবে রোগীর চলাফেরা কাজকর্মে কোনো অসুবিধা হবে না।
আর একটি জিনিসে জোর দিতে হবে। সেটি হলো স্ক্রিনিং টেস্ট। ধরা যাক কারো ঝুঁকিগুলো রয়েছে। যেমন : ডায়াবেটিস রয়েছে অথবা উচ্চ রক্তচাপ আছে। তাদের কিডনি রোগের উপসর্গ হওয়ার আগেও কিছু স্ক্রিনিং করা যায়। কিছু রুটিন পরীক্ষা করা যায়। যেমন খুব সহজ পরীক্ষা হলো, ইউরিন পরীক্ষা। রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা। প্রয়োজন মতে আলট্রাসনোগ্রাফি করতে বলি। এ থেকে আপনি আগেই বুঝতে পারবেন কিডনি রোগ হতে পারে কি না।
প্রশ্ন : প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে কী লাভ?
উত্তর : যদি আমরা আগে ধরতে পারি, তখন আরো কিছু পরীক্ষা করা যায়। যদি দেখি এই রোগীর ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ নেই, এরপরও এ রকম হচ্ছে, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, কিডনির মধ্যে আরো অনেক অসুখ রয়েছে। তখন সুনির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। এগুলো দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।