‘ভারতের সঙ্গে বড় যুদ্ধের আশঙ্কা নেই, তবে প্রস্তুত থাকতে হবে’

ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার ১১ দিন অতিক্রম করেছে। তবে এ ঘটনায় এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। দিনদিন এ উত্তেজনা আরও বাড়ছে। ২২ এপ্রিলের ওই হামলার পর থেকে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী একে অপরের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত এই হামলার জন্য পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও ইসলামাবাদ এই হত্যাকাণ্ডে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করেছে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
এ ঘটনায় ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তানও ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার পাল্টা হুমকি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, উভয় দেশ একে অপরের নাগরিকদের বহিষ্কার করেছে এবং কূটনৈতিক মিশনের সংখ্যা কমিয়েছে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার ১১ দিন অতিক্রম করেছে। তবে এ ঘটনায় এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। দিনদিন এ উত্তেজনা আরও বাড়ছে। ২২ এপ্রিলের ওই হামলার পর থেকে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী একে অপরের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত এই হামলার জন্য পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও ইসলামাবাদ এই হত্যাকাণ্ডে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করেছে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
এ ঘটনায় ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তানও ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার পাল্টা হুমকি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, উভয় দেশ একে অপরের নাগরিকদের বহিষ্কার করেছে এবং কূটনৈতিক মিশনের সংখ্যা কমিয়েছে।
এর আগে, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর থেকে বর্তমান উত্তেজনা সবচেয়ে গুরুতর রূপ নিয়েছে। ওই হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানের মাটিতে বিমান হামলা চালিয়েছিল। ২০২১ সাল থেকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উভয় দেশের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনাও ঘটছে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) মোঈদ ইউসুফ মনে করেন, ভারতের সঙ্গে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা কম, তবে পাকিস্তানের পূর্ণ প্রস্তুতি রাখা উচিত। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই সংকট এবং দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
আল জাজিরা : সংকট মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের পদক্ষেপকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মোঈদ ইউসুফ : ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর সংকট ব্যবস্থাপনার অভাবে ভুগছে। তাদের মধ্যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সংকট ব্যবস্থাপনা কাঠামো নেই, যা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। উভয় দেশই সংকটের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভর করে আসছে, এই আশায় যে, তারা উভয় পক্ষকে সংযত করতে এবং উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।
তবে, এবারের পরিস্থিতিতে ভারতের একটি বড় সমস্যা হলো তারা পুরোনো নীতি অনুসরণ করছে, কিন্তু তাদের প্রধান ভরসা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেইভাবে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মনে হচ্ছে তারা এখনও পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন ভারত ও পাকিস্তান নিজেরাই এই সংকট সমাধান করতে সক্ষম হবে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া সরাসরি ভারতের পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল এবং ঐতিহাসিকভাবে এমনটাই হয়ে এসেছে। উভয় দেশ একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। এবারও বেশ কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সমস্যা হলো, এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা সহজ কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হলে এগুলো প্রত্যাহার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আল জাজিরা : আপনি কি বিশ্বাস করেন যে একটি সামরিক সংঘাত আসন্ন এবং উভয় পক্ষই সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে?
ইউসুফ : এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। ভারতের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব নয়, তবে সেই সময় সম্ভবত পেরিয়ে গেছে। সাধারণত সংকটের সময় দেশগুলো সৈন্য বা রসদ স্থানান্তর শুরু করে, অথবা তাদের মিত্ররা তাদের অবহিত করে, অথবা গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভর করে সম্ভাব্য পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করে। তবে, এই তথ্য অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে।
পাকিস্তানকে স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার বার্তা দিতে হবে। অপ্রত্যাশিত যেকোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি। তবে, আমার মনে হয় না আমরা বড় ধরনের যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোনো ছোট ভুল বোঝাবুঝি বা ভুল হিসাবও বড় ধরনের সংঘাতের দিকে ধাবিত করতে পারে।
আল জাজিরা : এই সংকটে তৃতীয় পক্ষ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও উপসাগরীয় দেশগুলোর ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখেন এবং আপনি এটিকে পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর সঙ্গে কীভাবে তুলনা করবেন?
ইউসুফ : আমার শেষ বই (২০১৮) পাকিস্তান-ভারত প্রেক্ষাপটে তৃতীয় পক্ষের সংকট ব্যবস্থাপনার ওপর আলোকপাত করেছি। উভয় দেশই এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখে এবং তাদের নীতি নির্ধারণে এর প্রভাব রাখে। ধারণা করা হয়, তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারীর হস্তক্ষেপে উভয় দেশ উত্তেজনা কমাতে রাজি হবে।
১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। চীনসহ অন্যান্য দেশ সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে সমর্থন করে, যারা সংকটের সময় দ্রুত উত্তেজনা কমানোর ওপর জোর দেয়।
তবে, ২০১৬ সালের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা সংকটে এই পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়, যখন আমেরিকা ভারতকে সমর্থন দেয়। সম্ভবত তখন অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও ভারতকে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছিল।

কিন্তু এবার হোয়াইট হাউসে এমন একজন রাষ্ট্রপতি আছেন যিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান ও ভারতকে নিজেরাই বিষয়টি সমাধানের কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, এতে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ পাকিস্তান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য মার্কিন সমর্থনের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেছিল। কিন্তু ভারত আশা করেছিল আমেরিকা পাকিস্তানকে চাপ দেবে, যা বাস্তবে ঘটেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর ফোন কলে আবারও মধ্যস্থতার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
এছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলো আগের চেয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। চীনও সংযমের বার্তা দিয়েছে।
আল জাজিরা : এই সংকটের সময় বা পরে কোনো স্তরে ভারত-পাকিস্তানের সরাসরি আলোচনার আশা করছেন?
ইউসুফ : হ্যাঁ, আমি জানি না কখন বা কার সঙ্গে এটি হবে, তবে আমার মনে হয় এই সবকিছু শেষ হয়ে গেলে ভারতীয় পক্ষ সম্ভবত বুঝতে পারবে যে, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা বা সিমলা চুক্তি স্থগিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য দুই দেশকে আলোচনায় বসতে হবে। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে তারা আলোচনা করবে। তবে পাকিস্তান পুনর্মিলনের দিকে কোনো পদক্ষেপ নেবে না, কারণ আমরা বহুবার সংলাপের সুযোগ দিয়েছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পাকিস্তানের মনোভাবও এই প্রশ্নে দৃঢ় হয়েছে। পরিশেষে, ভারতীয়দের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আলোচনা করতে চায় কিনা। যদি তারা এগিয়ে আসে, আমি মনে করি পাকিস্তান এখনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাবে।
উল্লেখ্য, মোঈদ ইউসুফ ২০২১ সালের মে মাস থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। এর আগে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ে ইমরান খানের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন। বর্তমানে তিনি লাহোরে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আছেন। এছাড়া তিনি দক্ষিণ এশিয়া ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। তার সাম্প্রতিক বই ‘ব্রোকারিং পিস ইন নিউক্লিয়ার এনভায়রনমেন্টস : ইউএস ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়।