বিহারে নির্বাচনের আগে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তকমায় বিপাকে মুসলিমরা

ভারতের বিহার রাজ্যে আগামী নভেম্বরের বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে মুসলিম সম্প্রদায়, বিশেষ করে সীমাঞ্চল অঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলমানরা, নতুন করে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” তকমার মুখোমুখি হয়েছেন। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং এর সহযোগী নেতারা নির্বাচনী প্রচারে এই ইস্যুকে সামনে এনে রাজ্যের রাজনীতি উত্তপ্ত করে তুলেছেন। খবর আল জাজিরার।
‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা
দুই বছর আগে বিহারের কিশনগঞ্জ জেলায় এক জনসভায় রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির মিত্র জিতনরাম মাঞ্জি দাবি করেন, শেরশাহবাদি মুসলমানরা “বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী।” এই বক্তব্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে।
শেরশাহবাদি মুসলমানদের ভাষা বাংলা উপভাষার সঙ্গে হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রণ। ঐতিহাসিকভাবে তারা পশ্চিমবঙ্গের মালদা ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে গঙ্গার উজানে এসে বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েছিলেন।
কিশনগঞ্জের বাসিন্দা ও ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক মুক্তার আলম জানান, এই বক্তব্যের পর থেকে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার সুর বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, “আমাদের বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সবকিছু ভেঙে গেছে—এখন আমাদের শুধু সন্দেহের চোখে দেখা হয়।”
নির্বাচনের আগে মুসলিম বিরোধী প্রচারণা
বিহারের ১০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মুসলমান, অর্থাৎ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশেরও বেশি সীমাঞ্চল অঞ্চলে (কিশনগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া) বসবাস করেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বাধীনতা দিবসে ঘোষণা করেন, দেশ থেকে “অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত” করতে একটি ‘জনগণনা মিশন’ চালু হবে। যদিও তিনি কারা অনুপ্রবেশকারী তা স্পষ্ট করেননি, বিজেপির নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে সীমাঞ্চলের মুসলমানদেরই লক্ষ্য করছেন।
মোদির বক্তব্য, “যে কোনো দেশের জন্য অনুপ্রবেশ বিপদজনক। আমরা কাউকেই ছাড় দেবো না।”
বিহারে বিজেপি কখনো এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। পর্যবেক্ষকদের মতে, ধর্মীয় মেরুকরণ বাড়াতে ও মুসলিম ভোট ব্যাহত করতেই বিজেপি সীমাঞ্চলকে লক্ষ্যবস্তু করছে।
‘বাংলাদেশি’ আতঙ্কের রাজনৈতিক ব্যবহার
বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং সম্প্রতি পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে; আমাদের তাদের ধ্বংস করতে হবে।”
এমনকি তিনি গত বছর “হিন্দু প্রাইড মার্চ” আয়োজন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন, যেখানে ‘লাভ জিহাদ’ ও ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ’-এর মতো বিতর্কিত ইস্যুও উত্থাপন করা হয়।
বিজেপি বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, “এটি নির্বাচনী কৌশল নয়, বাস্তবতা। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, আগামী ২৫ বছরে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।”
তবে সমাজবিজ্ঞানী পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, “সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এটি কেবল ভোটের রাজনীতি। সীমাঞ্চল বাংলাদেশের সীমানা ভাগ করে না—তবু এই প্রচারণা চালানো হচ্ছে মুসলিমদের হেয় করতে।”
ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ
সম্প্রতি ভারতের নির্বাচন কমিশন বিহারে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে গিয়ে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে ৬ শতাংশের নাম মুছে দেয়। মুসলিম অধ্যুষিত কিশনগঞ্জে বাদ পড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ ভোটার—যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিজেপির নেতারা দাবি করেন, “এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভোটার তালিকায় ঢুকে পড়েছে।”
তবে সমালোচকদের মতে, এটি একধরনের ‘ডিলিট ড্রাইভ’, যার উদ্দেশ্য মুসলিম ভোটারদের ভোটাধিকার খর্ব করা।
সামাজিক প্রভাব ও ভয়ের আবহ
এই রাজনৈতিক বিভাজনের প্রভাব পড়ছে সমাজজীবনে। কিশনগঞ্জের স্কুল উদ্যোক্তা তাফহিম রহমান জানান, আগে তার স্কুলে ১৬ শতাংশ হিন্দু শিক্ষার্থী ছিল, এখন তা কমে ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, “ধর্মীয় বিভাজন এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হচ্ছে।”
একই অবস্থা চিকিৎসা খাতেও। স্থানীয় মুসলিম চিকিৎসক আজাদ আলম জানান, “হিন্দু রোগীরা মুসলিম চিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পান, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের কাছে।”

‘ভয়ের মধ্যে বেঁচে থাকা’
স্থানীয় শেরশাহবাদি মুসলমান আলম বলেন, “প্রতিবার রাজনীতিবিদরা আমাদের নিয়ে মন্তব্য করলেই আমাদের প্রমাণ দিতে হয়—আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। ভয় আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।”
সমাজবিজ্ঞানী আদিল হোসেন বলেন, “সীমাঞ্চলের প্রকৃত সমস্যা উন্নয়ন, কিন্তু সেটিকে নিরাপত্তা ইস্যু বানিয়ে মানুষকে ভয় আর অনিশ্চয়তায় রাখা হচ্ছে।”
তিনি যোগ করেন, “এই আতঙ্কই মানুষকে নাগরিক হিসেবে তাদের প্রকৃত সম্ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।”