যেভাবে ঘটল ভারতের সাম্প্রতিক হামলা
দিল্লির জনবহুল রাস্তায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হওয়ার ২৬ দিন আগে, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের উপকণ্ঠের নওগাম এলাকায় এক পুস্তিকা প্রকাশ হয়েছিল। সবুজ লেটারহেডে লেখা ওই পুস্তিকায় নিজেদের পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম)-এর অনুসারী হিসেবে দাবি করা হয়। খবর আল জাজিরার।
ভাঙা উর্দুতে লেখা ওই পুস্তিকায় ভারতীয় সরকারি বাহিনী এবং কাশ্মীরের সেই সব মানুষকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, যারা ‘আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে’ বলে অভিযোগ ছিল।
পুস্তিকায় লেখা ছিল, ‘যারা এই সতর্কতা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সময়ে এমন হুমকিমূলক পুস্তিকা ছিল সাধারণ ঘটনা। কিন্তু ২০১৯ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্যত্ব বাতিল করার পর এ ধরনের ঘটনা অনেক কমে আসে।
তবুও, এই পুস্তিকাকে ঘিরেই শুরু হয় তিন সপ্তাহব্যাপী তল্লাশি অভিযান—যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেয় দিল্লির ভয়াবহ বিস্ফোরণের সূত্রে।
তদন্তে উঠে আসে চিকিৎসক ও ধর্মীয় আলেমের নাম
নওগামে পাওয়া পুস্তিকার সূত্র ধরে পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটে কয়েকজন সন্দেহভাজনকে ধরে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ান জেলার ২৪ বছর বয়সী মুসলিম আলেম ইরফান আহমেদ। তার জবানবন্দিতে আসে আরেক নাম—চিকিৎসক আদিল রাথার, যিনি কুলগাম জেলার বাসিন্দা।
ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার লকার থেকে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল উদ্ধার হয়। রাথারের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে আরও এক সহকর্মীর নাম—মুজাম্মিল শাকিল গনাই, ফারিদাবাদে আল-ফালাহ ইউনিভার্সিটির চিকিৎসক।
গনাইয়ের ভাড়া নেওয়া দুটি বাসা থেকে পুলিশ প্রায় দুই হাজার ৯০০ কেজি বিস্ফোরক ও অস্ত্রসামগ্রী উদ্ধার করে।
‘ট্রান্সন্যাশনাল টেরর মডিউল’ ধ্বংসের দাবি
জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ জানিয়েছে, তারা জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) ও আনসার গাজওয়াত-উল-হিন্দ (এজিইউএইচ) সংশ্লিষ্ট একটি আন্তঃরাজ্য ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র ভেঙে দিয়েছে।
মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—যাদের মধ্যে তিনজন ডাক্তার, এক আলেম এবং এক নারীও রয়েছেন।
কিন্তু তদন্তে উঠে আসে আরেক নাম—ডা. উমর নবি। তাকে ধরার আগেই ঘটে দিল্লির রেড ফোর্টের পাশে ভয়াবহ গাড়ি বিস্ফোরণ। পুলিশের দাবি, বিস্ফোরণ ঘটানো গাড়ির চালকই ছিলেন উমর নবি।
বিস্ফোরণের পর কাশ্মীরে তল্লাশি অভিযানে আতঙ্ক
দিল্লির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়—একটি সাদা হুন্ডাই গাড়ি ধীরে ধীরে যানজটের মধ্যে ঢুকে হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়।
এরপর গোটা কাশ্মীরজুড়ে ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়। শুধু কুলগাম জেলায়ই ৪০০টি অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
উমর নাবির বাড়িতে শোক ও আতঙ্ক। তার বোন বলেন, ‘ও খুব শান্ত ছেলে ছিল, সবসময় বই নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছি না।’
একই অবস্থা মুজাম্মিল গনাইয়ের পরিবারেও। তার বাবা বলেন, ‘আমাদের ছেলে সবসময় পরিশ্রমী ছিল। পুলিশ হঠাৎ এসে বাড়ি তল্লাশি করে ওকে নিয়ে গেছে।’
ইসলামোফোবিয়া ও কাশ্মীরবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে শহরজুড়ে
বিস্ফোরণের পর দিল্লি, গুরগাঁও, নয়ডা প্রভৃতি শহরে কাশ্মীরিদের তালিকা তৈরি ও উচ্ছেদের ডাক ছড়াতে থাকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ায় ইসলামবিরোধী বক্তব্য ও হুমকি।
কাশ্মীরি শিক্ষার্থী সংগঠনের নেতা নাসির খুহামি বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন শহরে প্রায় দেড় লাখ কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। এখন সবাই আতঙ্কে আছে।’
সরকারের দাবি ও বাস্তবতা
কয়েক মাস আগেই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছিলেন—কাশ্মীরে ‘শূন্য নিয়োগ’ চলছে, নতুন কোনো জঙ্গি যোগ দিচ্ছে না। কিন্তু এই ঘটনায় সেই দাবি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অজয় সাহনি বলেন, ‘এদের মধ্যে কেউ জঙ্গি সংগঠনে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়নি। তারা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্ত হয়েছে—এটা ‘রিক্রুটমেন্ট’ নয়, বরং ‘মোবিলাইজেশন’।’
দিল্লির ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেবল একটি সন্ত্রাসী হামলা নয়—এটি ভারতের কাশ্মীর নীতি, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা তৎপরতা, এবং সমাজে ছড়ানো ইসলামোফোবিয়ার এক গভীর প্রতিফলন হয়ে উঠেছে।
তদন্ত এখনও চলছে, কিন্তু এর প্রভাব ইতোমধ্যেই দেশের ভেতর ও বাইরে আলোড়ন তুলেছে।

এনটিভি অনলাইন ডেস্ক